Answered 2 years ago
জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে আমি আর আমার হরিহর আত্মা রকিব একসাথে ভর্তি হয়েছি। রকিবের সাথে আমার ল্যাংটা কালের বন্ধুত্ব। প্রাথমিক, মাধ্যমিকে আমরা একসাথে, কলেজ আলাদা হলেও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সুবাদে আমরা সংযুক্ত ছিলাম।
দিনটি ছিলো ১৯৯১ সালের ২ ডিসেম্বর, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস। দুইটি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি ঘটনা আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এখানে সেটার কথাই বলবো।
তো হলো কী, ক্লাস শুরু হবে সকাল দশটায়। আমি আর রকিব মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে সকাল ৮ টায় নাস্তা করে ডিপার্টমেন্টের সামনের হেরিং বোনের ( তখন ক্যাম্পাসের সব রাস্তাই হেরিং বোনের ছিল। এখন পীচ ঢালা পথ)। রাস্তায় ক্যাফেটেরিয়ার পাশের ' অমর একুশে' ভাস্কর্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে রাজা উজির মারছি।
এমন সময় দেখলাম, রাস্তা দিয়ে রিক্সায় করে অনেকটা সুচিত্রা সেনের মত এক মহিলা আসছেন। পরিপাটি করে শাড়ি পরা, গলায় লম্বা চেইন দিয়ে একটা ট্যাক ঘড়ি ঝোলানো। ট্যাক ঘড়ি যে মহিলাদের অঙ্গসজ্জার বিষয় হতে পারে, সেটা জানা ছিল না।
ছবিঃ ড. খুরশীদা বেগম।
যাই হোক, রকিব বললো আমি যদি রিক্সায় উপবিষ্ট ঐ মহিলার কাছ থেকে দশ টাকা ভিক্ষা করে আনতে পারি তাহলে লাঞ্চে ক্যাফেটেরিয়ায় আমাকে খিচুড়ি খাওয়াবে। ভালবাসার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছিলেন। আর খিচুড়ির প্রতি আজন্ম আসক্ত আমি ভিক্ষাবৃত্তিতে নামলাম।
ছবিঃ চশমা পরা রকিব ও আমি।
ডিজিটাল যুগে মহিলাদের, ভিক্ষুকেরা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে, আমাদের সময় ভিক্ষুকেরা খালাম্মা ( মাসী) সম্বোধন করে ভিক্ষা প্রার্থণা করত। তো, সেমতে আমি সেই প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুন্দরী মহিলার কাছে গিয়ে বললাম, " খালাম্মা আমারে দশটা টাকা ভিক্ষা দিবেন?'
অপার বিস্ময়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। জানতে চাইলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কী না। উত্তর ইতিবাচক হতেই তিনি দেশ কাল যে উচ্ছন্নে যাচ্ছে, ছাত্ররা ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে, ছাত্রদের সাংস্কৃতিক রুচি কোন পর্যায়ে নেমেছে, পারিবারিক মুল্যবোধের কতখানি অবক্ষয় হয়েছে সে বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বকতৃতা দিলেন।
আমি নিরীহ গোবেচারার মত মুখ করে সুবোধ বালকের মত শুনলাম। কথা শেষ হলে বললাম, ' খালাম্মা অত কথা কন কেন? দশটা টাকাই তো চাইছি। দিবেন কী না কন?''
তিনি দশ টাকা দিলেন। দিয়ে গটগট করে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের দিকে হেটে গেলেন।
আমার তখন বিশ্বজয়। খিচুড়ি খাওয়ার আনন্দে চোখ চকচিক। রকিবের পরাজিত মুখ আর অপার বিস্ময় আমাকে এক পৈশাচিক আনন্দ দিয়েছিল।
কাহিনীটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হবে না। হলে এত কথা বলতাম না। শেষটা শুনতে হবে। শেষটাই এই কাহিনীর মূল উপজীব্য।
ক্লাসে বসেছি। ক্লাস মানে গ্যালারিতে। দেখি সেই অপরূপ সুন্দর, সুচিত্রা সেনের মত মহিলা হাজির। যাকে খালাম্মা ভেবে ভিক্ষা চেয়েছিলাম তিনি আর কেউ নন আমার শিক্ষক অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগম। তিনি ক্লাস নিলেন, ক্লাস শেষে আমাকে ইংগিত করে তার কক্ষে যেতে বললেন।
বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছুঁলে কত ঘা আমার জানা ছিল না। যাহোক আমি তাঁর কক্ষে গেলাম। তিনি নানা প্রশ্ন করে আমার পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর জানতে চাইলেন ভিক্ষা করার কারণ। আমি অকপটে সব কথা বললাম। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করতে করতে তিনি বললেন আজ সন্ধ্যায় আমার বাসায় এসো, রকিবকে নিয়ে। আমি তোমাদের খিচুড়ি খাওয়াব।
ছবিঃ আমার শিক্ষাগুরু ও আমি।
আমার এই শিক্ষক আমার মাতৃতুল্য, পরম পুজনীয়, শ্রদ্ধেয়, আমার ফিলসফার, আমার গাইড।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি ১৯৯৬ সালে। এখনো তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ আছে পারিবারিকভাবেই।
মাঝে মাঝে ভাবি ওইদিন হয়ত ভিক্ষা না করলে এই মহান পরশ পাথরের স্পর্শ আমি পেতাম না।
এ ঘটনা আপনাদের কেমন লাগলো জানি না, কিন্তু আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
ভাল থাকবেন।
romzanreza publisher