Answered 2 years ago
আহা, সব ইহুদিরা কেন দাদা, যাঁরা আছেন আগে তাঁদের কথাই ভাবা যাক না!
(আসলে এই প্রশ্নের অন্তর্নিহিত যে প্রশ্নটি সকলের মনে খোঁচা মারছে তা হল : 'ইহুদি ও হিন্দুদের আদৌ বনবে কি?')
আমরা যা ভুলে যাই তা হল : ভারত একমাত্র দেশ যেখানে ইহুদি বিদ্বেষ(Antisemitism)এর সম্মুখীন হতে হয়নি বিতাড়িত হয়ে আসা বেনে ইসরায়েলী(মহারাষ্ট্র) ও বাগদাদী ইহুদি(কেরালা) সম্প্রদায়ের মানুষকে — এবং এই কথা একা আমি নয়, তাঁরাই স্বয়ং বলেন। তাঁরা এই সমাজে মিশে গিয়েছেন, শাড়ি-ধুতি পরে দিন কাটিয়েছেন, পুরুষরা যোগ দিয়েছেন সেনাবাহিনীতে, কূটনীতিতে, নারীরা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী ও বলিউডি অভিনয়-শিল্পী হিসেবে চূড়ান্ত সফল হয়েছেন, সব, সঅঅঅব এসে মিলেছে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে
ইহুদিধর্ম ও হিন্দুধর্ম দুটোই আদতে ethno-religion; অতি সাম্প্রতিক কিছু আন্দোলন যেমন আর্য সমাজ, ইসকন বা Reform Judaism, Modern Orthodox Judaism প্রমুখের বাইরে ধর্মান্তরিত হয়ে ইহুদি অথবা হিন্দু হওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। উভয় ধর্মেই tribalismএর ছাপ সুস্পষ্ট; এবং এই কারণে তাঁরা মনে করেন যে তাঁদের ধর্মীয় নিয়মাবলী কেবল তাঁদের নিজেদের জন্য প্রযোজ্য, অন্যান্য জাতির মানুষের সেই সব পালন করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই, ধর্মান্তরকরণ-সংক্রান্ত ঝামেলা উভয় তরফ থেকেই হবে না, এমন আশা করা যায়('ঘর-ওয়াপসি'-brigade অথবা 'Messianic Judaism'এর ছাগল সুলভ কীর্তিকলাপ বাদ দিয়ে ধরলে)। পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকার এটা একটা বড় কারণ।
গড় হিসেবে দেখতে গেলে, ইহুদিরা অত্যন্ত মুক্তমনা ও পণ্ডিত জাতি। মাত্র ২৫-২৬% ইহুদি নিজেদের ধার্মিক বলে পরিচয় দেন, এবং সেই ২৫-২৬%এর মধ্যে ২% নিজেদের রক্ষণশীল বলে দাবী করেন। হারেদি, হাসিদিম, গের, লেভ তাহর ইত্যাদি কিছু অতি-রক্ষণশীল সম্প্রদায় বাদ দিলে ধর্মীয় চুলকানি ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে কম। তাঁদের সংস্পর্শে এসে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সাধারণ ভারতীয়রা যদি দেখাদেখি এই সদগুণ অভ্যাস করতে পারেন, তবে আখেরে আমাদেরই লাভ হবে। বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞান-চর্চার নিরিখেও ইহুদিরা বৈশ্বিক ভাবে অত্যন্ত এগিয়ে আছেন। স্বাস্থ্য, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান, অর্থনীতি, মহাকাশবিজ্ঞান, আবহবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ইতিহাস, সমরনীতি — সর্বত্র তাঁদের অবাধ বিচরণ, যথেচ্ছ পদচারণা। ভারতও বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশের নিরিখে পৃথিবীতে তিন নম্বরে অবস্থান করছে, এবং এই 'ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং' নিয়ে obsessed দেশে শিক্ষকমণ্ডলীর ব্যাপক অভাব পূরণ করতে পারেন বিদ্বান ও বিদূষী যত ইহুদিরা।
তবে আমেরিকা-ইউরোপের উন্নত দেশ ছেড়ে তাঁরা কেন এই হতদরিদ্র, অকৃতজ্ঞ একটা সমাজে এসে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে উদ্যত হবেন, আর আমরাই বা কেন সেই বেয়াড়া দাবী করব, এটা আমার মাথায় ঢোকে না। উল্টো, বর্তমানে তেলুগু ভাষাভাষী এবং উত্তরপূর্ব ভারতীয় কিছু গোষ্ঠী দাবী করছেন যে তাঁরা না কি ইহুদিদের অধুনালুপ্ত দশটি গোত্রের উত্তরসূরী(ইহুদিদের প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, তাঁদের আদিপুরুষ এব্রাহাম ও আদি জননী সারাহর পুত্র আইসাকের পুত্র জেকব; জেকবের বারো পুত্রের নামে ইসরায়েলের এক-একটি গোত্রের নাম, জ্যেষ্ঠ জুডাহ/ইসরায়েল ও কনিষ্ঠ বেঞ্জামিনের গোত্র ব্যতিরেকে বাকি দশটি গোত্র বর্তমানে নিরুদ্দেশ বলে গণ্য; এবং এই দশটির মধ্যে কয়েকটির উত্তরাধিকার দাবী করছেন উক্ত ভারতীয় জনগোষ্ঠীরা।) সহজে ইসরায়েলে অভিবাসন-প্রাপ্তির কৌশল? অসম্ভব নয়।
মোটামুটি ধার্মিক ইহুদিরাও ইসরায়েলে থাকতেই পছন্দ করেন।বাকি যে অতি-ধার্মিক ইহুদিরা আছেন, তাঁরাও আর কিছু উন্নত দেশে বসে social security cheque ভাঙিয়ে দশ-বারোটা আণ্ডা-বাচ্চা পয়দা করে পায়ের উপর পা তুলে বসে খাওয়ার চেয়ে এই গরীব দেশে আসতে কেন চাইবেন? আরও একটা কথা চুপিচুপি বলি, হাসিদিম-হারেদি-গের-লেভ তাহররা এখানে আসুন, সেটা আমিও একজন ভারতীয় হিসেবে চাই না। কেন, তা জানতে হলে নেটফ্লিক্সে 'আনর্থোডক্স' দেখতে পারেন, বা মূল বইটি পড়তে পারেন।
সব ইহুদিদের — আরবী-সিরিয়ান-আশকেনাৎজি-সেফার্দি — এখানে আসার দরকারটা কী? সব 'এক' করে কী লাভ যখন জীবনের প্রকাশই দ্বৈতে? সাদা-কালো, ভালো-মন্দ, নর-নারী, সবই বৈপরীত্যে, দ্বৈতে গিয়েই ঠেকে, যতই না আমরা অদ্বৈত খুঁজতে বসি। এমন কি জন্মও দ্বৈতেরই খেলা নয় কি? বাবা ও মা না থাকলে আজ আমরা কোথায় থাকতাম?
তার চেয়ে বেঁচে থাকুক নিসিম এজ়েকিয়েলের কবিতা, লীলা স্যামসনের অনির্বচনীয় ভরতনাট্যম, বেঁচে থাকুক কলকাতার 'জিউইশ গার্লস স্কুল' তার য়ম কিপুরের ছুটি আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ছাত্রী নিয়ে, থাকুক বহাল তবিয়তে মাগ়েন ডেভিড সিনাগগের মুসলিম কর্মকর্তারা, বেঁচে থাকুক মাট্টানচেরীর সিনাগগে রক্ষিত গ্রেট স্ক্রলের অংশবিশেষ, বেঁচে থাকুন একাত্তরের আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে পাকিস্তানী সেনাপতির কাছে আত্মসমর্পণের দাবী রাখা জে.এফ.আর. জেকব, এবং বেঁচে থাকুন 'জুলি' চলচ্চিত্রের মার্গারেট-রূপী নাদিরা, জুলি আর শশী-ইণ্ডিয়ানের সদ্যোজাত সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারংবার বলুন, "ম্যাঁয় তুঝে ছোড়কে জানা কভি নহি মাংতা…"
Mohon Ali publisher