Answered 2 years ago
ছোটবেলায় যখন ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, আর তারিণীখুড়ো পড়েছি তখন কে বেশি প্রিয় বা কেন বেশি প্রিয় এমনটা কখনও ভেবে দেখিনি । ফেলুদার মগজাস্ত্র, শঙ্কুর অদ্ভুতুড়ে অভিযান (যার মধ্যে "একশৃঙ্গ অভিযান"কে অনন্য বলা যায়) আর তারিণীখুড়োর অলৌকিক গল্পের আসর—সবারই নিজস্ব আবেদন ছিল আমার কাছে । কাউকে কারও সাথে তুলনা করিনি । এরপর সময়ের সাথে-সাথে অন্যান্য লেখকদের সৃষ্ট চরিত্রেদের সাথে পরিচিতি ঘটেছে আর তুলনা করার অবকাশ এসেছে । একইসাথে প্রাপ্তমনস্ক হওয়ার সাথে-সাথে কিছু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই সৃষ্টিগুলি সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জেগেছে যেগুলো এখানে তুলে ধরতে চাই ।
বর্তমানেও সত্যজিতের তিন সৃষ্টির কারোরই আমার কাছে কম বা বেশি আবেদন নেই তবে তাঁদের নিয়ে আলাদা আলাদা মতামত আছে যেগুলো এখানে এক এক করে উপস্থাপন করব ।
তারিণীখুড়ো
তারিণীখুড়োর ব্যাপারে আমার যেটা মনে হয়েছে তা হল অন্যান্য গল্প-বলিয়ে চরিত্রদের মত গল্পের আসরটা তিনি যেন ঠিক সেভাবে জমাতে পারেননি । গল্পের শ্রোতারা যেন বড্ডই বাধ্য স্বভাবের; কেউ খোঁচা দেয় না, অবিশ্বাস করে না । ভুতের গল্পগুলির ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে । বরদাচরণ ওরফে "বরদা" কিংবা তারানাথ তান্ত্রিকের শ্রোতাদের মধ্যেও যেমন দেখেছি একটা সংশয়বাদী মনোভাব থাকে, যে কারণে মূল গল্প আরো জমাটি হয় । এই দুই গল্প-বলিয়ে চরিত্রের কাছে তারিণীখুড়ো যেন কিছুটা ম্লানই হয়ে গিয়েছেন ।
ফেলুদা
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সৃষ্টি এই গোয়েন্দা চরিত্রকে সত্যজিৎ রায় গড়েছেন আর্থার কোনান ডয়েলের জগদ্বিখ্যাত সৃষ্টি শার্লক হোমসের আদলে । দুজনেই রহস্যের কিনারা করার জন্য যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেন তাকে বলে deductive reasoning; এই পদ্ধতি অনুযায়ী যুক্তির দ্বারা একে-একে বিভিন্ন সম্ভাবনাকে বাতিল করতে করতে যেটা শেষপর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে তা যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন তা আবশ্যিকভাবে প্রকৃত সত্য বলে গণ্য করতে হবে ।
তাত্ত্বিকভাবে এই পদ্ধতির কোনো সমস্যা নেই কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে বাস্তবে এর মাধ্যমে সবসময় তো অনেক দূর, অধিকাংশ সময়েও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যথেষ্ট কঠিন । বাস্তব জগতে সমস্ত ভুল সম্ভাবনাকে যুক্তি দিয়ে বাতিল করে দেওয়া প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার কারণ সেটা করতে যে পরিমান তথ্য লাগবে তা কারও কাছে থাকে না ।
একটা উদাহরণ দিই ফেলুদার গল্প থেকে— "ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা" গল্পটিতে ফেলুদা "ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন, একটু জিরো" র ধাঁধার সমাধানের সূত্র পায় "দরওয়াজা বন্ধ করো"র ইংরেজসুলভ বিকৃত উচ্চারণ "দেয়ার ওয়াজ আ ব্রাউন ক্রো" থেকে । এখন মেনে নিলাম যে "দরওয়াজা" আর "দেয়ার ওয়াজ আ"র মিল থেকে ফেলুদা বার করল যে "ত্রিনয়ন" হল আসলে "থ্রি নাইন" কিন্তু খটকাটা লাগে এর পরে গিয়ে । শূন্য বোঝাতে যে ধাঁধায় একবার "ও" ব্যবহার হয়েছে আরেকবার ইংরেজির "জিরো" সেটা ফেলুদা এত নিশ্চিতভাবে কী করে বুঝলো? এমনও তো হতে পারতো যে "জিরো" কথাটা বাংলায় "জিরোনো" বা বিশ্রাম নিতে বলার অর্থে বলা হয়েছে? "একটু"র সাথে "এইট টু"র মিল আছে ঠিক কিন্তু ধাঁধার একটা অংশ বাংলায় আর শেষের অংশ ইংরেজিতে এটা কি ফেলুদার একটুও বিসদৃশ ঠেকেনি? ফেলুদা কি সত্যিই deductive reasoning-এর মাধ্যমে ধাঁধার সঠিক সমাধান করেছিল? এইক্ষেত্রে সম্ভবত নয়, বরং ফেলুদা যেটার আশ্রয় নিয়েছিল তাকে বলা যেতে পারে inference to the best explanation, যেখানে উপলব্ধ তথ্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত অনুকল্প (hypothesis)কে বেছে নেওয়া হয় ।
হয়তো বলবেন, তাতে কী আসে যায়? ফেলুদা অপরাধীকে তো ঠিকই ধরেছিলো ! একদম ! তা নিয়ে কোনো কথা হবে না ! কিন্তু ফেলুদাকে প্রায়ই যেমন দেখা যায় লোকের চেহারা, ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য দেখে নির্ভুলভাবে তাঁদের সম্পর্কে কোনো গণনা করছে তেমনটা বাস্তবে হওয়া খুব কঠিন । শার্লকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । কারও মস্তিষ্ক যত ক্ষুরধারই হোক, মানুষের স্রেফ বাহ্যিকটুকু দেখে তাঁদের নিয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা বড়জোর ৫০% বা তারও কম ।
প্রফেসর শঙ্কু
বেশ কয়েক মাস আগের কথা; আমার এক সহকর্মীর সাথে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো । আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম "কল্পবিজ্ঞান" রচনার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যকে বিকৃত করাটা কতটা যথাযথ । সেই প্রসঙ্গে এসে পড়েছিল প্রফেসর শঙ্কুর কথা । আমি শঙ্কুর "আদিম মানুষ" গল্পটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেছিলাম যে গল্পটিতে বিবর্তনকে সম্পূর্ণভাবে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে । আমার সহকর্মী ব্যাপারটিকে সেভাবে আমল দেননি ।
আমল দেওয়ার মত ব্যাপার যে তা নয়; শঙ্কুর গল্প থেকে কেউ বিবর্তন শিখতে যাচ্ছে না । গল্পটা যখন প্রথম পড়ি তখন এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা-ভাবনাও করিনি । কিন্তু পরে যখন দেখলাম যে ধর্মীয় বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে কী পরিমান অকারণ বিতর্ক রয়েছে তখন সেই আলোয় শঙ্কুর গল্পটাকে দেখে মনে হয়েছে স্রেফ কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের নামে একটা বৈজ্ঞানিক সত্যকে এইভাবে অতিসরলীকৃত করাটা হয়তো অনুচিত ছিল ।
তবে শঙ্কুর গল্প নিয়ে আমার অসন্তোষের মূল কারণ এটা নয় (যদিও প্রাসঙ্গিক !); বরং সেটার কারণ হচ্ছে শঙ্কুর অন্যান্য কিছু গল্প যেখানে লেখক অলৌকিকতা, পরলোক, আত্মা ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা করেছেন ( "শঙ্কুর পরলোকচর্চা", "প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়", "প্রফেসর শঙ্কু ও চী-চিং" দ্রষ্টব্য) । আমার প্রশ্ন— কল্পবিজ্ঞানের গল্পে অলৌকিকতা কেন? এটা কোনো গর্হিত অপরাধ বলছি না, কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের গল্প কি বিজ্ঞানের সত্যের প্রতি বিশ্বস্ততা রেখে সুখপাঠ্য করে তোলা যায় না?
যারা ঘনাদা পড়েছেন তাঁরাই বুঝতে পারবেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে অবলম্বন করে এবং সেটাকে বিকৃত না করেও কত চমৎকার গল্প বোনা যায়; ঘনাদা কল্পবিজ্ঞান নয় ঠিক (যদিও "মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা"কে কল্পবিজ্ঞান বলা যায়) কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতায় ঘনাদা সম্ভবত শঙ্কুকে টেক্কা দিয়ে গেছেন ।
কল্পবিজ্ঞানের গল্পে অলৌকিকতা মেশানোয় আমার এমনিতে পাঠক হিসেবে আপত্তি নেই কিন্তু এতে কেমন যেন এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাই যে বৈজ্ঞানিক সত্য বুঝি এতটাই নিরস যে কিশোরদের জন্য সুপাঠ্য কোনো গল্পের ভিত্তি তা হতে পারেনা । বলা বাহুল্য, আমি এর সাথে একমত নই । কিছু মানুষকে এমন ধারণা করতে দেখেছি যে বিজ্ঞান সবকিছুর মধ্যে থেকে "ম্যাজিক"টা কেড়ে নেয়, তাকে সাধারণ বানিয়ে দেয় । এরকমটা দেখে মনে হয়— সত্যিই কি তাই? এই যে অজৈব পরমাণুদের মিথষ্ক্রিয়া থেকে জৈব পরমাণু আর সেখান থেকে শেষাবধি প্রাণের উদ্ভব, এটা ম্যাজিকাল নয়? আমাদের চেতনার আধার যে মস্তিষ্ক তা ৮০ বিলিয়ন নিউরোনের সমষ্টি; অথচ এই নিউরোনগুলির নিজের কোনো চেতনা বলে কিছু নেই । কিন্তু তা সত্ত্বেও ৮০ বিলিয়ন নিউরোন জড়ো হয়ে চেতনাযুক্ত প্রাণের সৃষ্টি করছে, এটা ম্যাজিকাল নয়?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো, ইউটিউবে অনেকদিন আগে কোনো একটা ভিডিও দেখতে গিয়ে একটা মন্তব্য পড়েছিলাম যেটা আজও মনে থেকে গেছে (অবিকল মনে নেই অবশ্য, তবে বক্তব্যটা মনে আছে); সেটা দিয়েই উত্তরে ইতি টানছি—
The universe is only more magical when you take the magic out of it.
hriyan publisher