শ্রীকৃষ্ণ কেন ছল কৌশল করে মহাভারতে পান্ডবদের জেতালেন?

1 Answers   6.6 K

Answered 1 year ago

কৃষ্ণকে নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে সব অপপ্রচার প্রসিদ্ধ রয়েছে তার মধ্যে কতকগুলি হল তিনি নাকি চোর,শঠ, চতুর, ছোটবেলায় নাকি মেয়েদের কাপড় চুরি করতেন,ছল-কৌশল করে কৌরব বীর যোদ্ধাদের পরাজিত করেছেন ইত্যাদি।অনেকে তো আবার তাহাকেই মহাভারতের যুদ্ধের জন্য দায়ী মনে করেন। আমি জানিনা কৃষ্ণ বলে সত্যিই কেউ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল, না এসবকিছুই মানুষের এক কল্পনা। সে যাই হোক আমি তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে জানতে এতো আগ্রহী নই। নিজে আমি তাকে এক আদর্শ বলে মনে করি। হয়তো আমি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ নাও থাকতে পারি কারন ছোটবেলা থেকেই তাহাকে ভগবান রূপে পূজো হতে দেখেছি। চিত্রসূত্র- গুগল কৃষ্ণের চরিত্র নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মতাদর্শ খুব ভালো লাগে। তিনি ব্যক্ত করেছেন যে - 'মহাভারত' যেটি সবচেয়ে প্রাচীন ও বিশ্বাসযোগ্য গ্রন্থ কৃষ্ণের সম্বন্ধে জানার জন্য, সেটি যুগে যুগে বিভিন্ন কবির দ্বারা হস্তক্ষেপ হয়েছে‌। যেমন পুরনো বাড়ির মেঝেতে সময়ের সাথে সাথে শ্যাওলার স্তর জমতে থাকে ফলে সেখানের আসল যে মাটি তা ঢাকা পড়ে যায়।সেরকমই এই ভীষন হস্তক্ষেপের জন্য মহাভারতের যে আদিম ভার্সন যেটির মধ্যে কোনো মৌলিকত্ব থাকলেও থাকতে পারে তা ঢাকা পড়ে আছে। যদি সরল ভাবে বলা যায় তাহলে মহাভারতের তিনটি স্তর। তার মধ্যে প্রথম স্তরই সবচেয়ে প্রাচীন ও মৌলিক। এই স্তরের কাব্য রচনাতে খুব বেশি অলঙ্কার বা রস নেই কিন্তু গল্পে অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তাও নেই। এক কথায় বললে এটি ছাড়া মহাভারতের কোনো গুরুত্ব নেই এবং এর গল্প মহাভারত থেকে বাদ দিয়ে দিলে গ্রন্থ অচল।এই স্তরের কাহিনী মূলত কৃষ্ণ, পঞ্চপান্ডব ও কৌরবদের ঘিরে। বাকি দুটি স্তর প্রথম স্তরের ওপর অনেককাল পরে চড়ানো হয়েছে অন্যান্য কবিদের দ্বারা। যেগুলিতে মুলকাহিনির বাইরেও অনেককিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা যোগ করা হয়ছে, বা যদি সেগুলি সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে মূল মহাভারতের তেমন কোনো ক্ষতি হয়ে যাবেনা। এখন যদি কেউ মহাভারত খুঁটিয়ে পড়ে তাহলে এরকম অনেক জায়গা পাবে সে যেখানে একটি অংশ আরেকটি অংশের সাথে Contradict করছে। এর কারন হল যুগে যুগে অনেক কবির দ্বারা রচনা। তাছাড়া মহাভারতের চারিদিকে এত প্রকাশন রয়েছে যে কোনটা ঠিক কি কোনটা ভুল জানা মুশকিল। কোথাও কোথাও দেখা যাবে কৃষ্ণ নিজে এমন সব আচরণ করেছেন যেটি তাহার বলা গীতার বানীর ঠিক উল্টো। এছাড়াও অনেক ধরণের রূপকথার গল্পও রয়েছে যেমন দ্রোণাচার্যের জন্ম - তিনি নাকি এক কলসির মধ্যে জন্মেছেন তাও আবার খালি শুক্রাণু দিয়ে,ডিম্বাণু ছাড়া। এই ধরনের প্রচুর আষাঢ়ে গল্প রয়েছে। এতগুলো কবির কলমের জন্যই নাকি কৃষ্ণের চরিত্রে এতো বিকৃতি ঘটেছে। কেউ কেউ তাহাকে গ্রন্থে ভগবান প্রমান করার জন্য প্রচুর অলৌকিক কথা জুড়ে মানবিক ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে Overglorify করার চেষ্টা করেছেন। আবার কোনো কৃষ্ণবিদ্বেষী এমন কিছু লিখেছে যা কৃষ্ণের চরিত্রকে কলঙ্কিত করতে ভালোরকম ভাবে সক্ষম। - (কৃষ্ণ চরিত্র- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হুবহু তাহার শব্দগুলি কে এখানে লিখিনি কারন কৃষ্ণচরিত্র অনেক আগে স্কুলজীবনে পড়েছিলাম আর বর্তমানে আমার কাছে সে বইটিও নেই) এতোকিছু বিকৃতির পরেও আমার মহাভারত পড়ে এটা মনে হয়নি যে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের জন্য দায়ী। বরং তিনি যুদ্ধকে আটকানোর জন্য যে প্রয়াস করেছিলেন তা ভীষ্ম বিদুরও করেননি। শত্রুপক্ষের লোক হওয়া স্বত্তেও তিনি নিরস্ত্র হয়ে হস্তিনাপুরের সভায় গিয়েছিলেন শান্তির প্রস্তাবের জন্য, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেখানে গিয়ে নিজের সর্বপ্রচেষ্টা করেছিলেন এই যুদ্ধ রোখার। কিন্তু মূর্খ দূর্যোধন, শকুনি, কর্নরা শোনেনি তাহার পরামর্শ। কৃষ্ণ নিজেকে প্রধানত মনুষ্য রূপেই প্রকাশিত করেছেন বারবার এবং এমন কোনো কাজ করেননি যেগুলি মানুষের দ্বারা অসাধ্য। তিনি গীতায় যে সব কথাগুলো বলেছেন নিজের জীবনে তিনি সেইসবেরই এক প্রকৃত উদাহরন ছিলেন।অনেকবার তিনি নিজের কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, যেমন এই ভয়াবহ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আটকানো। কিন্তু গীতার ধর্ম অনুযায়ী ফলের প্রত্যাশার চেয়ে কর্ম বেশি জরুরি। আর তিনি এই কর্মে সফল, যেগুলির মধ্যে একটি হল সমাজের মঙ্গলের জন্য যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্য স্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা। মহাভারতে কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব অনেক পরে এসেছে এবং তা আনার জন্য দায়ী মূলত গ্রন্থের দ্বিতীয় স্তরের কবিরা। তাদের ধারণ এটা যে ঈশ্বরই সব কিছুর জন্য দায়ী। যদি তিনি মানুষকে দিয়ে পুণ্য করাতে পারেন তাহলে পাপও করাতে পারেন, মানুষকে যেমন ন্যায় করেন তেমনি অন্যায়ও করেন। তাই তারা নিজেদের বানানো রচনায় জয়দ্রথ বধে দেখিয়েছেন ভুল ধারনা বা ভ্রান্তি(কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র দিয়ে সূর্য ঢেকে দেওয়া), ঘটোৎকচ বধে দেখিয়েছেন কুবুদ্ধি(কর্নকে নিজের এক পুরুষঘাতিনী অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য করানোর জন্য ঘটোৎকচকে পাঠানো) , দ্রোণবধে দেখিয়েছেন অসত্য(তাহাকে হারানোর জন্য যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ বলে বিশ্বাসঘাকতা), আর দূর্যোধন বধে দেখিয়েছেন অন্যায়(ভীমকে গদা যুদ্ধে দুর্যোধনের উরুতে প্রহার করার ইঙ্গিত দেওয়া যেটি নিয়মের বাইরে)। এবার কৃষ্ণকে যদি আমরা ইশ্বর বা ভগবান রূপে দেখি তাহলে এইসকল কার্যগুলো অবশ্যই জাস্টিফাইড কিন্তু তাহলে তাকে এক আদর্শ বা Ideal Person বলতে পারিনা। পারি কি ? এখানেই আসে মহাভারতের প্রথম স্তর যেখানে কোনো আলাদা কবির হস্তক্ষেপ নেই । যেখানে কৃষ্ণ কোনো ইশ্বর নয় কিন্তু অনেকেরই কাছে পূজ্য, যেখানে কৃষ্ণের কোনো অলৌকিকতা নেই কিন্তু নিজের মনুষ্য শক্তিতে অনেক কঠিন কার্য করতে সক্ষম, যেখানে কৃষ্ণ শারীরিক ভাবে শক্তিমান, মানসিক ভাবে বুদ্ধিমান, রূপে মনোহর, নীতিজ্ঞ, ধর্মজ্ঞ, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, নিরহঙ্কার ও তপস্বী। ধন্যবাদ 🙏
Shilpi
Shilpi
462 Points

Popular Questions