সদ্য কৈশোরে পা দেয়া কিশোর কিশোরী হোক বা বুড়ো বুড়ি প্রেম টানে সবাই কুপোকাত।
"ভালোবাসার মন ফাগুনে, তোমার জন্য সুর বুনেছি।
সুরের সাথে তাল সাজিয়ে, ছোট্ট একটি গান লিখেছি।
গানের ভাষায়, মনের আশায় তোমার একটা নাম রেখেছি।
নামের সাথে যতন করে, তোমায় অনেক ভালোবেসেছি। "
কিন্তু এই প্রেমই আমাদের জীবনে বয়ে আনতে পারে চরম দুর্যোগ যদি না প্রেম আর আকর্ষণের ( ক্রাশ ) পার্থক্য টা বুঝতে পারি।
আভিধানিক অর্থে ক্রাশ হল অল্প সময়ের জন্য কাউকে ভালোলাগা। যারা স্বল্প মেয়াদী ব্যাপার-স্যাপারে আস্থাশীল নন তাঁদের জন্য আছে প্রেমে পরা। গাছ থেকে পরা, খাট থেকে পরার মতোই আর-কি; হাড়গোড় ভাঙার সম্ভাবনা প্রবল!
ধরা যাক ,আপনি প্রেমে পরেছেন। আপনার প্রেমিক/ প্রেমিকাও আপনার প্রেমে হাবুডুবু যাকে বলে, কিন্তু মুস্কিল হল ওই প্রেম নামক অতিকায় বিষয় কখনও একা থাকতে পারে না, সংগে নিয়ে আসে অনেক ঝকমারি। অমুকের দিকে তাকাবে না, তমুকের সঙ্গে কথা বলবে না; ফোন করো নি কেন, ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন, এইসব ছোট ক্যাচাল পেরিয়েই আসে আমার বাড়ি- তোমার বাড়ি, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ।
সেই তুলনায় ক্রাশ এসব ক্যাচাল মুক্ত! শুধু গুনে মুগ্ধ, রূপেও, অ্যাপো-র টাইমিং নিয়েও ঝামেলা নেই, কপাল গুনে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে গেলে আপনার চোখে- মুখে পড়ে পাওয়ার চৌদ্দ আনার খুশির ঝলক, আর দেখা না হলে 'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ' অর্থাৎ 'ইস খেল মে দোনো তরফ সে জিৎ তুমহারা হি হ্যায় সিকান্দার!'
আবার ধরুন, আপনার ক্রাশ যদি আপনার প্রোফাইল ভিজিট করেন একটিবারের তরে তাহলেই আপনার পূর্বরাগ জমে ক্ষীর সাগর দই! ক্রাশ হল হ্যান্ডি এবং ট্রেন্ডি। হ্যান্ডল উইথ প্রপার কেয়ার টাইপ, সাবধান বাণী কে বুড়ো আঙুল! প্রতিবেশী, সহপাঠী, শিক্ষক- শিক্ষিকা, বোনের বন্ধু, বন্ধুর বোন, বান্ধবীর দাদা সহ সীমানাটা অনেক প্রশস্ত, শুধু আপনার মনটা দরকার।
প্রেম করবেন নাকি ক্রাশ খাবেন সেটা আপনার ব্যাপার। একতরফা হোক অথবা দু'তরফা,অপরপক্ষ সম্মত না হলেও বিষয়টা তার অজানা নয় ,উনিও জানেন এবং বিলক্ষণ সুখী হন! ভাবুন তো একবার, পুজো প্যান্ডেলে আপনার দিকে কেউ আড়চোখে তাকাচ্ছে বারবার অথবা হাঁ করে চেয়ে আছে অথবা আপনাকে অযাচিত ভাবে সাহায্য করছে। পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার জন্য বরাদ্দ ফুল - বেলপাতার কমতি হচ্ছে না আপনার, আপনার অর্পণ করা অঞ্জলি বিনা বাধায় মায়ের পায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কেউ ভীষণ তৎপর! বলুন আপনি বুঝবেন না এ কিসের সংকেত! বেচারা বদলে কিছুই চায় না, নিষ্কাম কর্মের প্রায় কাছাকাছি স্তরের কর্ম এসব। কামনা বলতে শুধুই একটু পাল্টা মনোযোগ।
একবার এক বান্ধবীর মুখে শুনেছিলাম তার এক সহপাঠিনীর গল্প। আমার সেই বান্ধবী ও তার সহপাঠিনী এক কোচিং সেন্টারে পড়তে যেত, সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। কোচিংয়ের অঙ্ক স্যারকে ভালো লেগে যায় আমার বান্ধবীর সহপাঠিনীর। ঝড়- জল দুর্যোগ উপেক্ষা করে হলেও মামনির ক্লাসে যাওয়া চাই-ই চাই, অঙ্কের স্যারের ক্লাস কি কামাই করা যায়! কালের নিয়মে পাঠচক্র শেষ হল, ক্রাশ স্যার ও তাঁর দর্শন অভিলাষী ছাত্রী 'দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে' গেল। কিছু বছর পরে ছাত্রী গেল নিজের মেয়েকে কিন্ডারগার্ডেন থেকে আনতে; অন্য এক অভিভাবক ঠায় তাকিয়ে আছেন তার দিকে; সেই অভিভাবকের ছেলেও পড়ে এই কিন্ডারগার্ডেনে। মেয়ের মায়ের কোনও হেলদোল না দেখে ছেলের বাবাই এগিয়ে এলেন, "এক্সকিউজ মি, ম্যাডাম, আপনি অমুক কোচিং সেন্টারের তমুক ব্রাঞ্চে পড়তেন তো? আমি আপনাদের অঙ্ক শেখাতাম, মনে পরে?"
প্রশংসক ভুলে মেরে দিয়েছে ক্রাশকে, কিন্তু ক্রাশ ঠিক মনে রেখেছেন। মনোযোগ দেওয়া একেই বলে! ভুললে চলবে, ক্রাশ স্যার অঙ্কের লোক, মনোযোগ তাঁর সব দিকেই বেশি!
ক্রাশ খান অথবা প্রেমে পড়ুন, মন - মেজাজের লক্ষণ এক রকমই।অল্পেই মন খুশিতে ডগমগ আবার ক্ষণিকেই বিষাদের কালো ছায়া; আলো - আঁধারি যেন স্বয়ংক্রিয়!
আপনার বেছে দেওয়া ফোটো থেকে বানানো প্রোফাইল ফটো বদলে গেল তো আপনার মেজাজও সপ্তমে; দেখাচ্ছি মজা! সন্তোষজনক জবাব আসা মাত্রই আপনি গলে জল!
আবার ধরুন আপনার তিনি খুবই রাশভারী অথবা রক্ষণশীল, অন্তত আপনার তাইই ধারনা। সবাই ওনাকে সমঝে চলেন, ইয়ার্কি ঠাট্টা করতে কেউ সাহস দেখায় না, কিন্তু আচমকা সোশ্যাল-মিডিয়ার ফোটোতে কেউ লঘু রসিকতা জুড়ল; আপনার মন কালো মেঘে ছেয়ে গেল, সে মেঘ আবার শরতের মেঘ; সহজে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরার কোনও সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই রসিক ব্যক্তির আসল পরিচয়, আপনার ওনার সাথে রসিক চূড়ামণির নির্ভেজাল সম্পর্কের উপযুক্ত প্রমাণ না পাচ্ছেন আপনার নাওয়া- খাওয়া মাথায়। অথবা আপনার তার প্রোফাইল-পিকচারে অন্য একজন লাভ রিয়েকশন দিয়েছে,লাইক দিলে তাও মানা যায়; কিন্তু লাভ সাইন! এ যে দিনে- দুপুরে ডাকাতি; তারপর অনেক সোনা- বাবু'র পর্ব মিটিয়ে আপনি শান্ত হলেন বটে তবে মনে কাঁটাটা আটকেই থাকলো!
সকাল-সকাল অনলাইন হয়েই প্রথম গুড মর্নিং মেসেজটি কার থেকে পাওয়ার আশা করেন? পেলেন তো ঠিক আছে, না পেলে সাত- সতেরো চিন্তা! পুজো- ঈদ- পয়লা বৈশাখের শপিং-এড্রেস- গয়নার বাছাই পর্বে মনের কোনে ঝিলিক মেরে যায় না সে? এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া-বিহীন উদ্দীপক আর কোথায় পাবেন! এই করোনা আবহে যখন মাস্ক দিয়ে সবার মুখ ঢাকা তখন কেউ কি তাঁর ক্রাশকে চিনতে ভুল করেছেন? বোধ হয় না।
উত্তর আধুনিকতার যুগে বিয়ের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্ন চিহ্নর মুখে, যৌনতা তো পার্মানেন্ট নন্দ ঘোষ, বৈধতা- নৈতিকতার পরীক্ষায় সে কোনোদিনই পাশ করতে পারেনি ,কিন্তু প্রেম? তাকে অস্বীকার করে কার সাধ্য!! শ্রীকৃষ্ণ থেকে চণ্ডীদাস হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, গণতান্ত্রিক বা রক্ষণশীল অথবা উদারপন্থী কিংবা বাম এবং অতিবাম সবাই এক রোডের রাখাল, শুধু ওই এক ইস্যুতে।
প্রেম কি শুধু এই এক অর্থেই বিরাজমান, এর ব্যাপক রূপ নেই? আছে। ধরুন আপনার দিদা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসেন, দিদিমা আবার তাঁর বাপের বাড়ির কয়েকজন লোকের কাছে মহা ভিআইপি, তাহলে দিদিমার বাপের বাড়ীর লোকদের কাছে আপনার স্থান হল সুপার ভিআইপির! আপনি হলেন তাঁদের ক্রাশ এর ক্রাশ,আপনার সৌভাগ্য রথী- মহারথীদেরও ঈর্ষার কারণ হবে! আরও এক ব্যাপকর্থে প্রেম আছে; ভক্ত - ভগবানের প্রেম। যোগী - সাধকের ঈশ্বর প্রেমের কথা বাদ দিলেও সাধারণ মানুষের ঈশ্বর প্রেমই বা কম কিসে! হে ভগবান, ব্যাঙ্কের সুদের হার কমিয়ে দাও। জমিটা বেঁচে ফ্ল্যাট কিনব ভাবছি, জমির দাম বাড়িয়ে দাও - জমি বিক্রির টাকাতেই যেন কুলিয়ে যায়, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাতে যেন হাত না দিতে হয়! ছাত্র - ছাত্রীরা চায় উপপাদ্য তো বটেই এক্সট্রাও যেন কমন পাই! গৃহবধূদের চাহিদার তো কোনও শেষ নেই- স্বামী, সন্তানের মঙ্গল থেকে শুরু করে শাশুড়ি ননদের অমঙ্গল থেকে নিয়ে চুল ওঠা কমানো সবটাই ভগবানের ইচ্ছাধীন! প্রেমের আরেক নাম তো নির্ভরতা, নাকি!!
দেশকাল নির্বিশেষে চলে আসা এই কনসেপ্টটি যুগধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হবে সেটাই স্বাভাবিক, সামাজিক জটিলতার জাতায় পরে অন্যান্য সম্পর্কগুলোর মতোই এই সম্পর্কটিও বিভিন্ন সময়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, হচ্ছে। প্রেমকে কেন্দ্র করে চলছে নানা রকমের অবক্ষয়ও, সমাজে যদি সার্বিকভাবে নৈতিক অবক্ষয় আসে প্রেমও তার বাইরে নয়। আর্থসামাজিক বিবর্তনে কতোই না কাটা-ছেঁড়া সইতে হয় এই মুক্তোদানা সদৃশ অনুভূতিকে।
সমাজ - পরিবার জুড়েই চলে এক অদৃশ্য 'আমরা-ওরা', 'দল - উপদল', 'কাছের লোক- দূরের লোক' গোছের বাতাবরণ। এতো ধরনের পক্ষপাত, স্বজনপোষণের মধ্যে আপনার - আমার একজন স্পেশাল লোক থাকতে পারে না? শুধু দেখতে হবে স্পেশাল যেন সাধারণীকরণের প্রবণতায় দুপুর-বৌদি বা বিকেল-ঠাকুরপো টাইপ বিকৃতির শিকার না হয়। প্রেমিকা, 'বৌদি' বা 'মাল' হয় কি ভাবে? বড়ভাই-এর স্ত্রী হন বৌদি, স্বামীর ছোট ভাইকে বলে দেওর। আপনার প্রেমকে এমন অপভ্রংশর মুখে ফেলে দেবেন?এতো প্রেমের মহিমাকে বিবর্ণ করার অপচেষ্টা। ভাইয়ের স্ত্রী বৌদি থাকুন আর স্বামীর ছোটভাই দেওর থাকুক, প্রেমিক - প্রেমিকা থাকুক স্বমহিমায়। তবে হ্যাঁ, কোনও ঝিঙ্কু মামনি যদি আপনাকে দাদা বলে ডাকে তবে পুরোপুরি আশাহত হবেন না; হতভাগিনী বাঙালিনী ক্রাশকেও দাদা ডাকে! এ হেন স্পেশাল মানুষটির জন্য অন্য কারো স্বার্থ বিঘ্নিত না হলেই হল , বাকিটা সুপ্রীম কোর্ট সামলে দেবেন, নো চাপ!
।
।
ধন্যবাদ
শ্রীমতী লিলি বসু বিশ্বাস
❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️
tanvirahmed publisher