Answered 2 years ago
আরবি ভাষার 'হারাম' শব্দ থেকে এসেছে 'হারেম' শব্দটি। বিষয়টিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। বলা হয় 'হারেম' শব্দটি এসেছে আরবি 'হারাম' (অবৈধ) কথাটি থেকে। তুর্কিরা কথাটিকে সহনীয় করে নেয়, তারপর যোগ করে 'লিক'। ফলে তুর্কি ভাষায় বাড়ির যে অংশে মহিলারা থাকেন তার নাম হয় 'হারেমলিক'। ইউরোপীয়রা 'হারেম'কে জানে 'সেরালিয়ো' নামে। এখানে ইতালিয়ান ও ফারসি ভাষার এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ ঘটেছে। ইতালিয়ান ভাষায় 'সেররালিয়োন' কথাটির অর্থ 'বন্য প্রাণীর খাঁচা'। এর উৎপত্তি লাতিন 'সেরা' (গরাদ) থেকে। তবে ফারসি 'সরা' ও 'সরাই' (ভবন, বিশেষ করে প্রাসাদ, কিন্তু উপমহাদেশে অর্থ দাঁড়িয়েছে বিরতিস্থল ও পান্থশালা) শব্দের সঙ্গে কাকতালীয় সাদৃশ্যের কারণে এমন অর্থান্তর ঘটেছে এর।..... পালি ভাষায় মহিলাদের আবাসস্থলকে বলা হয় 'ইত্থাগারা' (স্ত্রী আগার)'। পুরুষের বহুগামিতাকে প্রশয় ও লালন করার জন্য হারেমের উৎপত্তি।
ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র বেদে এক পুরুষ কর্তৃক বহু নারীভোগের বিষয়টি উল্লিখিত হয় নি। এ-প্রথা বেদ-উত্তর কালের। ব্রাহ্মণ্য উপনিষদে (আনুমানিক ৫০০ পূর্বাব্দ) অবশ্য বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। 'জাতক'কে যদি প্রাক-বৌদ্ধযুগের সমাজচিত্র বলে গ্রহণ করা যায় তা হলে বলতে হয় বুদ্ধের আবির্ভাবের আগে, পূর্বাব্দের পঞ্চম শতকে, বিশেষভাবে পুরুষদের বহুগামিতা প্রচলিত ছিল। 'মহাপদ্মজাতক'-এ ১৬ হাজার রমণী-অধ্যুষিত এক রাজকীয় 'সেরালিয়ো'র উল্লেখ আছে। সংখ্যাটি হয়তো অতিরঞ্জিত, কিন্তু এই উল্লেখ প্রাকবৌদ্ধ যুগে 'ইত্থাগারা' থাকার অকাট্য প্রমাণ। অবন্তীর' রাজা প্রদ্যেৎ, মগধের রাজা বিম্বিসার (আনুমানিক ৫৪৬-৯৪ পূর্বাব্দ), বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু (আনুমানিক ৪৬২-৯৪ পূর্বাব্দ) এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব (আনুমানিক ৫৬৬-৪৮৬ পূর্বাব্দ) -এর সমসাময়িক রাজা উদয়নের শাসনকালে হারেম ছিল ।
মুসলিম যুগের হারেম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ১৪শ শতাব্দী থেকে। দাক্ষিণাত্যের গুলবর্গ রাজ্যের অধিপতি ফিরোজ শাহ বাহমিনি এক দিনে তিনশত পত্নী গ্রহণ করেছিলেন। মুগল আমলে জেনানা বিভাগ নামে একটি আলাদা বিভাগই ছিল হারেমকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। আবুল ফজল তার লেখায় জানিয়েছেন- আকবর এক বিশাল প্রাচীরবেষ্টিত ভবন তৈরি করিয়েছিলেন- যেখানে তিনি প্রায়ই বিশ্রাম নিতেন। তাঁর হারেমে পাঁচ হাজারের বেশি রমণী ছিল-যাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ছিল আলাদা-আলাদা কক্ষ।
হারেমের ভিতর যে অসহায় মেয়েরা ছিল তাদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত ছিল শুধুমাত্র খোজা পুরুষ। তারা ছাড়া আর কেউ জেনানামহলে প্রবেশ করতে পারত না। পুরনারীদের বিনোদনের জন্য হারেমের ভেতর বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। বিভিন্ন রীতি ও নিয়মনীতির বেড়াজালে বন্দী ছিল হারেমের নারীরা। তাদের জন্য যে কক্ষগুলো বরাদ্দ ছিল তার সামনে ছিল ফুল বাগান, ঝরণা, চৌবাচ্চা, ছায়াবীথি, ফোয়ারা, নকল গুহা ইত্যাদি। নিজস্ব দাস ও দাসী ছিল তাদের।
রাজা-বাদশাদের চোখে যাদেরকে ভাল লাগত সেইসব নারীদেরকে হারেমে নিয়ে আসা হত।
হারেম পরিপূর্ণ থাকত নানা দেশের নানা জাতির রমণীতে। তাদের যাচাই-বাছাইয়ের ব্যাপারটি পুরোপুরি নির্ভর করতো রাজা-বাদশাহর খামখেয়ালের ওপর। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আমলে এই যাচাই-বাছাই চলতো কিভাবে তা জানা যায় না। তবে পরবর্তীকালের অবস্থা দেখে মনে হয় সেকালেও চলেছে একই নিয়ম: সুন্দরী মেয়েদের যোগাড় করা হয়েছে দালাল, উমেদার ও বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে, যুদ্ধবন্দিরেদ মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে, পিতা-মাতাদের কাছ থেকে কিনে এবং অন্যান্য উপায়ে। হঠাৎ কোথাও দেখে ভাল লেগে-যাওয়া মহিলাদেরও রাজা-বাদশারা নিয়ে এসেছেন হারেমে।
হারেমের জীবন রাজাদের জন্য সবসময় আনন্দ বয়ে আনত তা নয়। কখনও কখনও হারেমের অভ্যন্তরে সংঘটিত ষড়যন্ত্র রাজার জন্য প্রাণঘাতী রূপ লাভ করত।
উৎসঃ হারেমের কাহিনীঃ জীবন ও যৌনতা - সাযযাদ কাদির
masrafimortoza publisher