Answered 2 years ago
ভ্রমণ অনেক ভাবে অনেক নতুন কিছু আমাকে শিখিয়েছে । কিছু হয়তো বই পড়ে একটু ধারণা ছিল।কিন্তু বাস্তবেও যে সেরকম হতে পারে সে ধারণাটা ছিলোনা। আমরা বইতে পড়েছি সবার উপরে মানুষ সত্য, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, এইসব কথা। কিন্তু যখন আপনি নিজের অভিজ্ঞতায় নিজের চোখে উদাহরণগুলো দেখবেন তখন অবাক তো হবেনই তার সাথে ওই কথা গুলোর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি একজন ভ্রমণপ্রিয় অভিযানপ্রিয় মানুষ। সোজাপথে সোজা যেতে আমার ভালো লাগে না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পাহাড় জঙ্গল ঠেঙিয়ে বেড়াতে আমার বেশি ভালো লাগে। এরকম একটু কিছু বলি, তাহলে ভ্রমণ থেকে আমি অল্পসল্প নতুন কি শিখেছি তা বোঝা যাবে হয়তো। উঠলো বাই তো কটক যাই এর মত দুর্গাপূজার পঞ্চমীর দিন আমার এক বন্ধুকে বললাম, চল দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসি। আমার বন্ধু তো একপায়ে খাড়া। তখন ওকে বুঝিয়ে বললাম যে আসলে আমি সাইকেলে করে এই ভ্রমণ টা করতে চাই । শুনে ও তো আরও লাফাতে লাগলো।পাহাড়ে সাইকেলে?? দারুন মজা হবে । এখানে এটা বলে রাখা ভালো যে আমার ওই বন্ধু যার নাম বাচ্চু সে জীবনে কোনোদিন পাহাড় দেখেইনি। সে যাই হোক।বাড়িতে হাজার গালাগালি এসব মেনে নিয়ে একটা ব্যাগ সাইকেলের পেছনে নিয়ে দুই বন্ধু পুজোর দিন সাইকেল অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম। গোটা অভিযানটাই ঘটনা বহুল । তার থেকে দু একটি এই প্রসঙ্গে বলি।
আমরা তখন বহরমপুরে থাকতাম তাই সেখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। সকাল থেকে সাইকেল চালাতাম মাঝে রাস্তার ধাবায় খেতাম আর যেখানে রাত হয়ে যেত সেখানে কোথাও ম্যানেজ করে থাকতাম।এই ছিল মোটামুটি থিম।এইভাবে এক সন্ধ্যায় ডালখোলা পৌছালাম। সারাদিন সাইকেল চালিয়ে খুব ক্লান্ত।অনেক ঘোরাঘুরি করেও থাকার জায়গা মিলছিলো না। হঠাৎ সামনে অনুকূল ঠাকুরের এক আশ্রমের দেখা মিললো।উল্লেখ্য ভগবান ঈশ্বর ধর্ম এদের সাথে আমার একটুও বনিবনা নেই। আর তথাকথিত বাবা বা গুরুদের তো কথাই নেই। গোটা কলেজ জীবনটাই প্রায় কেটেছে এদের ভণ্ডামি বিরুদ্ধে কাজ করে। আমি এসব থেকে একশো হাত দূরে থাকি সবসময়। তাই অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের পাশ দিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম। বাচ্চু , মানে আমার বন্ধুটা বললো "একবার গিয়ে দেখবো আশ্রমে? অনেক রাত হলো থাকার জায়গা তো পাওয়াই যাচ্ছে না। যদি ওখানে কিছু সাহায্য পাওয়া যায়।" আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম "চল দেখা যাক একবার গিয়ে"। এই বলে দুই মূর্তিমান সারাদিনের পরিশ্রমে বিধ্বস্ত অবস্থায় আশ্রমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম। যমদূতের মতো এক নেপালি বাহাদুর দারোয়ান হাজির হলো।এতো রাতে কি চাই? বললাম যে এই আশ্রমের যিনি দায়িত্বে আছেন তার সাথে একটু দেখা করতে চাই। অনেক প্রশ্ন উত্তরের পর অপেক্ষা করতে বলা হলো এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ভদ্রলোক কে খবর দেওয়া হলো। কিছুক্ষন পরে ভদ্রলোক এলেন । সাদা ধুতি পরনে গায়ে সাদা একটা কাপড়। কাল ফ্রেমের চশমা। লম্বা চওড়া সুপুরুষ এক ভদ্রলোক। বিভিন্ন ভাবে আমাদের জেরা করে আমাদের যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই সে সম্মন্ধে নিশ্চিত হলেন। আমাদের কাছে অবশ্য এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের থাকার অনুমতি দিযে একজন কে আমাদের দায়িত্ব দিয়ে প্রস্থান করলেন। দায়িত্ববান সেই ছোকরা আমাদের একটা ঘরে নিয়ে এলো। বারান্দায় সাইকেল রেখে আমরা আনন্দের সাথে ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকেই আমাদের সব আনন্দ চুপসে গেল। ঘর টা আসলে একটা বাথরুমের এক্সটেনশন। বাথরুমের দরজা টা নেই ।উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে সেখান থেকে। দু তিনটে খাটিয়া রাখা আছে । আর টিম টিম করে একটা বাল্ব জ্বলছে । ব্যাস এই হলো ঘর।খাটিয়া টা ঠিক করে একটু বসতে গেলাম। কিন্তু এবার ঝাঁকে ঝাঁকে মশার আক্রমন শুরু হলো। কি সাইজ এক একটা মশার। ঠিক যেন ভ্যাম্পায়ারএর ক্ষুদ্র সংস্করণ। কিন্তু আমাদের এতে সেরকম খুব একটা খারাপ কিছু লাগেনি।লাগার কথাও নয়।কারণ আমরা বেরিয়েইছি এডভেঞ্চার করতে।এরকম যে হবে তাতো আমরা জানিই।এটাই ভাগ্য আমাদের যে ফুটপাতে থাকতে হচ্ছে না।আর এটা একটা নিশ্চিত আশ্রয়।একটু গন্ধ আর সামান্য মশা কে তো মানিয়ে নিতেই হবে। দুমদাম করে যখন মশা মারতে ব্যস্ত আমরা, তখন আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ছোকরার আগমন। মিষ্টভাষী স্পষ্টবক্তা ব্যক্তির এবারের নির্দেশ "চলুন প্রার্থনার সময় হয়ে গেছে , প্রার্থনায় যোগ দিতে হবে এখন"। কি প্রার্থনা , কেমন প্রার্থনা, আমাদের কেন সেখানে যোগ দিতে হবে।এসব প্রশ্নের কোনো অবকাশই নেই। চললাম ওর পেছন পেছন। বিশাল এক মন্দিরে গিয়ে বসলাম । মন্দিরের বেদিতে অনুকূল ঠাকুরের মূর্তি। মূর্তির সামনে একজন পুরোহিত পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত। খোল করতাল এর মতো কিছু বাদ্যযন্ত্র সামনে রাখা আছে। আমাদের পাশে দু একজন কাসর ঘন্টা নিয়ে বসে আছেন আরতির সময় বাজানো হবে বলে।এখানে বলে রাখি আমার বন্ধু বাচ্চু ও একজন অসম্ভব ভালো তবলচি। রবীন্দ্রসদনে বড়ো বড়ো ওস্তাদ দের সাথে ও তবলা বাজিয়ে থাকে। সামনে রাখা বাদ্যযন্ত্র থেকে একটা ড্রাম জাতীয় যন্ত্র ও ফট করে কোলে তুলে নিল।আর আমাকে একটা করতাল হাতে দিয়ে রেডি হতে বললো। ব্যাস কিছুক্ষনের মধ্যেই আরতি শুরু হয়ে গেল । খোল করতাল কাসর ঘন্টা সব বাজতে লাগলো। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে গেল বাচ্চুর বাজনা। এত চমৎকার বাজনা ও বাজাতে লাগলো যে অন্যসব বাজনা পেছনে পড়ে থাকলো। পুরোহিত আরতি করতে করতে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার বোঝার চেষ্টা করছিলেন বাজনার ব্যাপারটা। গোটা নাটমন্দির ভর্তি লোক মন্ত্রমুগ্ধের মত আরতি আর এর বাচ্চুর বাজনা অবাক হয়ে শুনছিলো। এই লেভেলের কোনো বাদক এখানে কোনোদিন বাজায়নি বলেই আমার মনে হলো। ঘন্টাখানেক পর আরতি শেষ হলো । ভাবলাম বাঁচা গেল । কিন্তু না এবার আবার মন্দির প্রদক্ষিণ করার পালা। আগে ধুনুচি নিয়ে পুরোহিত চলেছেন পেছনে কাসর ঘন্টা খোল করতাল নিয়ে আমরা । সাতবার মন্দির ঘোরার পর আবার মন্দিরে ফেরত এলাম। এবার আরও দ্রুতলয়ে বাচ্চুর বাজনা শুরু হলো।পুরোহিতের আরতির তাল রাখাই মুশকিল হচ্ছিল ওই বাজনার সাথে। সবকিছুরই একটা শেষ তো থাকেই।সেইরকম আরতিও একসময় শেষ হলো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো আমি বাঁচলাম। খোল করতাল রেখে আমরা মন্দির থেকে বেরোলাম।মন্দির ভর্তি লোক আমাদের বেরোনোর রাস্তা করে দিলো।আর এতই অবাক হয়েছিল সবাই যে হাঁ করে আমাদের দেখছিল । কোথাকার দুই উটকো ছোকরা কেউ চেনেনা জানেনা এখানে এসে বাজনা কেন বাজাচ্ছে । এটাই হয়তো প্রশ্ন ছিল সবার।কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন আমাদের করেনি। আমরা আমাদের ঘরে গিয়ে একটু ধাতস্থ হওয়ার জন্য বসলাম।সারাদিনের সাইকেল ভ্রমণের ধকল বড়ো কম নয়।তারপর অনিশ্চিত রাত্রিযাপনের এক টেনশন তো থাকেই। খাবার ও কোনো ঠিক নেই। তারপর আজ আবার এই কীর্তন। খুবই ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছিলো নিজেদের।
আশ্রম থেকে দুই মূর্তি বেরোলাম রাতের খাবারের আশায়। কাছেই একটা ধাবা পাওয়া গেল।সেখানে আরাম করে তারকা রুটি চা সব খেলাম।মনে হলো যেন ধড়ে একটু প্রাণ এলো।রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়ালাম খোলা হওয়ায়।আশ্রমের ঘরের কথা মনে হলেই যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল।আবার ওই বাথরুমের পাশে রাত কাটাতে হবে এত মশার মধ্যে এসব মনে হলেই আর যেতেই ইচ্ছে করছিল না। তবুও যেতে তো হবেই।তাই ফিরে এলাম বাথরুমের পাশে আমাদের রাতের আশ্রয়ে।ফিরে এসে দেখি এক অবাক কান্ড। আশ্রমের তত্বাবধায়ক ভদ্রলোক এবং আরো কয়েকজন আশ্রমের হর্তাকর্তা সমেত আমাদের জন্য সংরক্ষিত ঘরে আমাদের জন্যই অপেক্ষারত। আমাদের দেখে উনারা উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।খুবই লজ্জিত ভাবে এবং বিনম্র ভাবে আজ যে আমাদের বাইরে খেয়ে আসতে হলো তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন।কোনো কারণ ছাড়াই বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তারপর আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ছেলেটিকে ডেকে একটু মৃদু ধমক দিয়ে বললেন যে সে যেন আমাদের লাগেজ উঠিয়ে নিয়ে অন্য একটা ঘরে পৌঁছে দেয়। তারপর আমাদের সঙ্গে করে আমাদের জন্য অন্য একটা শোবার ঘর বন্দোবস্ত হয়েছে এটা জানিয়ে আমাদের সেখানে নিয়ে চললেন। দোতলায় ঘর দেখে তো আমরা তাজ্জব হয়ে গেলাম।অসাধারণ একটা ঘর দুপাশে ধবধবে সাদা বেডকভার দেওয়া দুটি বিছানা মাঝখানে সাইড টেবিলে মিনারেল ওয়াটার এর বোতল।এবং একটি টেলিফোন।আমাদের কে আরাম করতে বলে উনারা বিদায় নিলেন।আমাদের ঘোর কাটার আগেই যমদূত দারোয়ান আবির্ভুত হলেন। তবে এখন আর অতটা যমদূত যেন মনে হচ্ছে না তাকে। বিনয়ের অবতার এর মত তিনি জানালেন যে দরজা লক করার কোনো প্রয়োজন নেই।উনি পাহারায় থাকবেন। এবং যেহেতু আমরা সকাল 6 টায় বেরোবো তাই উনি আমাদের ঠিক 5 টায় উঠিয়ে দেবেন। উনার সময়জ্ঞান সম্পর্কে কোনোরকম সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই কারণ উনার নিয়মানুবর্তিতা দেখে বড়দা মানে অনুকূল ঠাকুরের বড়ছেলে উনাকে একটি টাইটান ঘড়ি উপহার দিয়েছেন। তার ডানহাতে বাধা সুন্দর ঘড়িটাও দেখিয়ে দিলেন আমাদের। এরপর কীই বা করার থাকতে পারে জয়গুরু বলে আমরা সেই সুন্দর বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
ভোরবেলায় উঠলাম আমরা।জয়গুরু বলে প্রহরী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিয়ে আমরা নিচে সাইকেল নিতে গেলাম।নিচে গিয়ে আমরা তো হতবাক হয়ে গেলাম।এতটা বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল আমাদের জন্য তা আমরা ধারণাই করতে পারিনি। গোটা আশ্রম যেন আমাদের জন্য নিচে অপেক্ষমান। সেই ছেলেটা আমাদের সাইকেল তেল দিয়ে মুছে পরিষ্কার করছে। আর সবাই আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কাছে যেতেই জয়গুরু বলে আমাদের তাঁরা নমস্কার জানালেন। একজন কয়েকটা থানকুনি পাতা এবং এক গ্লাস জল নিয়ে এলেন।তাদের কথামতো থানকুনি পাতা চিবিয়ে খেয়ে একগ্লাস জল খেলাম।এতে নাকি পেটের সমস্যার সমাধান হয়। তারপর একজন কিছু নারকেল নাড়ু একটা প্যাকেট করে আমাদের দিলেন রাস্তায় খাওয়ার জন্য। তত্বাবধায়ক মহাশয় একটা কাগজে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রাস্তার প্রায় প্রতিটি মোড়ে মোড়ে যত তাদের শিষ্য আছেন তাদের নাম ঠিকানা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দিলেন।ফোন করে সবাই কে আমাদের কথা জানিয়ে দেবেন বললেন। এরকম অনাহুতের মতো ঘুরতে যেন না হয় তার জন্য সব ব্যবস্থা উনি করে দেবেন , কোথাও আমাদের কোনো সমস্যা আর উনি হতেই দেবেন না। এবার আমাদের বিদায় নেবার পালা । অশ্রুসিক্ত নয়নে সবাইকে নমস্কার করে আমরা বিদায় নিলাম।হাতজোড় করে আমাদের বিদায় জানালেন তারা।এসেছিলাম দুই উটকো ভবঘুরে, বেরোচ্ছি দুই ভি,আই, পি হয়ে। আমরা তো কিছুই করিনি।আমাদের কাছ থেকে কিছুই চাওয়ার বা পাওয়ার ওই আশ্রমবাসীদের ছিলোনা।মানুষ শুধু মানবিকতার জন্য কিভাবে পর কে পর বললেও ভুল হবে চেনা নেই শোনা নেই দুই ভাবঘুরেকেও কিভাবে আপন করে একরাতে তাকে মায়ায় বেঁধে ফেলতে পারা যায় এটা আগে কখনো দেখিনি।মানুষ কে বিশ্বাস না করাটাই তখন পাপ বলে মনে হয়। হয়তো নতুন নয়।কিন্তু এরকম মানুষ আছে বলেই আজও পৃথিবীটা এত সুন্দর।আমার ভ্রমণে আমি বার বার এই কথার প্ৰত্যক্ষ প্রমান পেয়েছি ব্যতিক্রম থাকলেও মানুষের ভরসা এবং আশ্রয় একমাত্র মানুষই হয়।তার জন্য চেনা পরিচিত হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
triptykhan publisher