Answered 2 years ago
সূর্যাস্ত দেখতে খরচ কুড়ি হাজার রুপিয়া!
সিঙ্গাপুর থেকে বালি দ্বীপের ডেনপাসার এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বিমান ছাড়ল। বেশ কয়েক ঘন্টা যাত্রাবিরতির পর মুক্তির আস্বাদ। এমনিতে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট ভারি জমকালো। ঝাঁ- চকচকে সব ব্যাপার। সময় কাটানোর যাবতীয় উপাদান। তবে সে সবে মন ভরছিল না। আসলে মন তখন বালিময়। উইন্ডো সিট পেয়েছিলাম। বালির কাছাকাছি আসতেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি শুধু জল আর জল। ডেনপাসারে নামার সময় তো আঁতকেই উঠেছিলাম। শেষে কি জলে নামবে নাকি প্লেনটা!
বালি
বালি দ্বীপ এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। বালি দ্বীপের মানুষ পর্যটকপ্রিয়, তাই আন্তরিক। পর্যটন শিল্প দারুণ গুরুত্ব পায় এখানে। কলকাতা থেকে বালির সময় ২.৩০ ঘন্টা এগিয়ে। বিমানবন্দরে যখন নামলাম তখন বালির সময় বেলা দেড়টা। ছোট্ট বিমানবন্দর, কিন্তু সব ব্যবস্থা মজুত। যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে আসতেই একটি বালিনিজ মেয়ে ফুল দিয়ে মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালো। পর্যটকদের বালিনিজরা এভাবেই অভ্যর্থনা করেন।
কুটা
সেদিন এবং আমাদের পরবর্তী দিনগুলিতে আবহাওয়া ছিল বেশ পরিস্কার। ঝকঝকে আকাশ। ট্যাক্সি নিয়ে আধঘন্টার মধ্যে কুটা পৌঁছে গেলাম। বালির মুদ্রা হল ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া। এই মুদ্রা চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া হল এক লক্ষ রুপিয়া। চমকে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। আসলে আমাদের ৫০০ টাকা (৪৮৩ টাকা) ওদের ১,০০,০০০ রুপিয়ার সমান। কুটা সৈকতের কাছেই ছিল আমাদের হোটেল। সৈকত ঘিরেই এখানে হোটেল গড়ে উঠেছে। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে সমুদ্র দেখতে ছুটলাম। বালির কুটা সমুদ্র সৈকতকে অসামান্য বললে কম বলা হবে। অসম্ভব পরিচ্ছন্ন এর পরিবেশ। জলের রঙ সবুজাভ-নীল। বালির রঙ সাদা, যেন পাউডার। সৈকতে ওয়াটার স্পোর্টসের এলাহি ব্যবস্থা। ওয়াটার সার্ফিং-এর পাশাপাশি চলে সার্ফিং-এর ক্লাসও। বিদেশি নারী-পুরুষে ছেয়ে আছে গোটা সৈকত। কেউ স্নান করছেন তো কেউ সাদা বালিতে শুয়ে আছেন। কেউ বই পড়ছেন তো কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। সবাই নিজের মতো করে উপভোগ করছেন সমুদ্র সৈকত। সন্ধ্যা নেমে আসতেই বদলে গেল গোটা পরিবেশ। পাকা রাস্তার ওধারের শপিং মল, রেস্তোরাঁ ও অন্য সব দোকানে জ্বলে উঠল হরেক আলো। ভেসে আসতে লাগল তুমুল বাজনার আওয়াজ। কুটার রাস্তা খুব বেশি চওড়া নয়। রাস্তার ধারের বাড়ি বা দোকানে ফুল ও বাঁশকে খুব সুন্দর ভাবে ব্যবহার করা হয় এখানে। বাড়িঘর তেমন উঁচু নয়। রাস্তার দু’পাশের কাঠের কারুকাজ করা বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী চোখ টানবেই। কুটার রাত বড় মোহময়ী। হাসিঠাট্টা, খানা-পিনা, নাচা-গানা, গল্পগুজব চলে রাতভর। রাত যত গভীর হয় তত যেন প্রাণ পায় এই দ্বীপ।
কিন্তামনি
পরদিন সকালে আমরা প্রথমে গেলাম কিন্তামনি। কিন্তামনি পাহাড়ি এলাকা। উচ্চতা আনুমানিক সাড়ে চার হাজার ফুট। বালিদ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় মাউন্ট আগুং আছে এখানে। আছে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট বাটুর এবং পাহাড় ঘেঁষা বাটুর লেক। পথে কমলালেবুর বাগান পড়ল। অসম্ভব সুন্দর এখানকার পরিবেশ। তাজা কালো লাভা নিয়ে তাকিয়ে আছে আদিগন্ত বিস্তৃত মাউন্ট আগুং। যে কোনও সময় শুরু হতে পারে লাভা উদ্গীরণ। কিন্তামনিতে দুপুরের খাবার খেলাম এক চমত্কার রেষ্টুরেন্টে। খেতে খেতেই মাউন্ট বাটুর দেখছিলাম।
উবুদ
কিন্তামনি থেকে উবুদের দূরত্ব ৩৫ কিমি। উবুদের পাহাড়ি পরিবেশে ধানখেত দারুণ চিত্তাকর্ষক। এখানে ঝুম চাষ করা হয়। বালির অর্থনীতিতে পর্যটন মূল ভূমিকা নিলেও বহু মানুষ কৃষিনির্ভর। আর এই কৃষিকাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানে আছে ধান।
তানাহ লট
বালিতে অসংখ্য মন্দির। তবে তার মধ্যে অগ্রগন্য স্থানে আছে তানাহ লট মন্দির। বলা হয়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত থেকে রক্ষা পেতে তানাহ লটে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল। সমুদ্রের মধ্যে এক বিশাল পাথরের ওপর মন্দিরটি গড়ে ওঠে। জোয়ারের সময় মন্দিরের অনেকটা জলের নীচে চলে গেলে মনে হয় যেন সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে সেটি। ভাটার সময় ভিত্তিসহ মন্দিরটি দৃষ্টিগোচর হয়। মন্দির প্রবেশের জন্য প্রবেশমূল্য লাগে। উবুদ থেকে ২৮ কিমি দূরে তানাহ লট মন্দিরে যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়ে এসেছে। সমুদ্রের জল ডিঙিয়ে সেই মন্দিরে গেলাম। সেখান থেকে সূর্যাস্ত, অসম্ভব সুন্দর সে দৃশ্য।
জিমবারান
কুটা থেকে ১২ কিমি দূরে জিমবারান। জিমবারানের সামুদ্রিক খাবার বিখ্যাত। খোলা আকাশের নিচে রেষ্টুরেন্টে বসে সাগরের ঢেউ গুনতে গুনতে খাওয়াদাওয়া করার সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। সঙ্গে চলছে লাইভ মিউজিক। জিমবারানে খাবার খাওয়ার খরচ কিছুটা বেশি পড়ে ঠিকই, তবে বালি বেড়াতে এসে আঞ্চলিক খাবার খাবেন না, তাই-ই বা কী করে হয়? অনেকটা সময় জিমবারানে কাটিয়ে চললাম উলুওয়াটুর উদ্দেশ্যে।
উলুওয়াটু
কুটা থেকে ২৫ কিমি আর জিমবারান থেকে ১২ কিমি দূরে উলুওয়াটু। বালির দক্ষিণতম প্রান্তে অবস্থিত সূর্যাস্তের জন্য বিখ্যাত উলুওয়াটু যেন আমাদের কন্যাকুমারী। সানসেট পয়েন্টের প্রবেশমূল্য ২০ হাজার রুপিয়া। সমুদ্রের পাশে বেশ উঁচু একটা পাহাড় থেকে সুর্যদেবের পাটে যাওয়া দেখতে হয়। বহু নিচে সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে। সেদিকে তাকালে হাড় হিম হয়ে আসে। যখন দিগন্ত লাল হয়ে এল, তখন সাগর, পাহাড়, সবুজ জঙ্গল ও সূর্যাস্ত সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত অপার্থিবতা। সন্ধে বেলায় দেখতে গেলাম ‘কেকাক ফায়ার অ্যান্ড ট্রান্স ডান্স’। মুক্তমঞ্চে অসামান্য অভিজ্ঞতা হল। কোনও বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা ছাড়াও শুধুমাত্র সম্মেলক গলার আওয়াজে এমন নাচ হতে পারে- আগে কখনও ভাবিনি। অংশ নিয়েছিলেন বালির নারী-পুরুষ।
জেনে রাখুন
বালির আয়তন ৫,৬৩২ বর্গকিমি। ইন্দোনেশিয়ার ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে বালি একটি।
ইন্দোনেশিয়া মুসলিম প্রধান হলেও বালির বালিনিজদের প্রায় সিংহভাগ হিন্দু। এখানে প্রচুর মন্দির। তাই বালিকে বলা হয় দেবতাদের দ্বীপ বা শান্তির দ্বীপ।
বালির ওয়াটার রাইড দারুণ মজাদার। সমুদ্রের নিচের মাছ, কোরাল, অক্টোপাসের জগতে ঘুরে আসুন। জলের তলায় আছে মেরিন গার্ডেনও। দক্ষ ডাইভারের সঙ্গে সাঁতার কাটতে পারবেন।
কোনওরকম জামানত ছাড়া বালিতে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। শুধু ২৪ ঘণ্টার ভাড়া আগাম লাগে। মোটামুটি ৫ লাখ রুপিয়ায় সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।
শুধু বালি নয়, গোটা ইন্দোনেশিয়াতেই জনপ্রিয় খাবারটির নাম ‘নাসি গোরেং’। মিস করবেন না।
৩০ দিনের জন্য বালি বেড়াতে ভারতীয়দের কোনও ভিসা লাগে না। বিমানবন্দরে নেমে নির্দিষ্ট খরচ দিয়ে ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা করে নেওয়া যায়।
mstsalmakhatun publisher