Answered 2 years ago
প্রিয়তমার সাথে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে, নিয়তির ইশারায় হবু প্রিয়তমার সাথে ভ্রমণ করার অম্লমধুর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কোরা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার জন্য এ প্রচেষ্টা।
সেবার অনার্স পরীক্ষার পর সামনে লম্বা ছুটি। ছুটিটা কিভাবে কাটানো যায় তা নিয়ে প্লান প্রোগ্রাম মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ এক ঝাপটা মিষ্টি হাওয়ার মত লন্ডন প্রবাসী মামা তাঁদের সাথে কিছু দিন কাটিয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
একে লন্ডন, তার উপর শিশুতোষ ছড়ার ভাষায় মামার বাড়ি ভারী মজায় দিন কাটানোর হাতছানি। আমি তো যাকে বলে, মহানন্দে স্বপ্নের রাজ্যে ভাসছি —Floating above cloud nine.
আহ্ লন্ডন! সে ত স্বপ্নের শহর। ছোটকাল থেকেই শুনে আসছি বিলাতের নাম। মনে গেঁথে রয়েছে যা কিছু উৎকৃষ্ট তা সবই বিলাতের মাল—বিলেতি কাপড়, প্রসাধন, বিলেতি সিগারেট, বিলেত ফেরত ডাক্তার, ব্যারিস্টার—এই সব আরকি।
কেউ বিলেতি মেম বিয়ে করে আনলে তো কথাই নেই। চারিদিকে হুলুস্থুল পড়ে যায়। প্রতিবেশীরা মেম দেখার জন্য কারণে-অকারণে বাড়িতে ভিড় জমান। এলাকার কাজের বুয়ারা কনফারেন্স ডেকে রসাল মন্তব্য পরিবেশন করতে থাকে, মেমর শরিল এক্কেরে রসুনের নাহাল সাদা।
পাসপোর্ট, টিকেট, ফরেন এক্সচেঞ্জ, ভিসা জোগাড়ের জন্য ছোটাছুটি লেগে গেল। সব চাইতে বেশি সমস্যা দেখা গেল, চারিদিক আত্মীয়-স্বজনের বর্ষিত অনর্গল উপদেশমালার ফোয়ারা, কোথায় কখন কি করতে হবে সে সম্পর্কে শলা পরামর্শ। পরিশেষে, বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক দুর সম্পর্কের ভ্রাতা আমাকে বিস্তারিত লেকচার দেওয়ার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন।
তার প্রথম উপদেশ, কি করে ভালো একটা সিট জোগাড় করা যায় সে জন্য আগেভাগে প্ল্যান করা।
তিনি বললেন, "সবচেয়ে ভালো সিট প্লেনের একেবারে সামনের সারিতে। সামনে প্রচুর পা ছড়িয়ে বসার জায়গা। আজকাল উড়োজাহাজ কোম্পানি ইকোনমি ক্লাসে সাধারণ সিট এত চাপাচাপি করে রেখে দেয় যে পা মেলে একটু আরাম করে বসবেন সে সুযোগ থাকে না"।
তিনি লেকচারে এক মিনিট বিরতি দিয়ে আবার ব্রিফিং শুরু করলেন, "সামনের সিটে বসলে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর চট করে নেমে পড়া যায়। পিছনের দিকে বসলে নামার সময় হুড়োহুড়ি,কে কার আগে যাবে তা নিয়ে ঠেলাঠেলি বেঁধে যায়"।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, যদি সামনের সিট না পাওয়া যায়, তাহলে কি করব?
দুরসম্পর্কের ভ্রাতা আবার তার বক্তৃতা শুরু করলেন, "বিকল্প হিসেবে তুমি এমারজেন্সি এক্সিটের সাথে লাগোয়া সিট জোগাড় করার চেষ্টা করবে। সে সিট থেকেও পা লম্বা করে বসার সুযোগ তো আছেই, পথে প্লেনের 'যদি কিছু হয়ে যায়' তখন দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হতে পারবে।
ব্রাদারের বাতলে দেওয়া সবগুলো স্টেপ যথাযথভাবে পালন করা হলো। তার পরামর্শ মতো সামনের সারিতে সুবিধা মতো সিটও পেয়ে গেলাম।
প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করে মনে খুশির আবেশ দোলা দিয়ে গেল। বোনাস হিসাবে দেখলাম পাশে বসে আছে একজন তরুণী। অপূর্ব সুন্দরী বললে বাড়িয়ে বলা হবে। তবে, সে বয়সে, 'ফুলের বনে যাকে দেখে তাকেই লাগে ভালো' টাইপের। গানটার একটি কলি গুনগুনিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করলাম, 'রজনীগন্ধা তুমি গন্ধসুধা ঢালো, ফুলের বনে যাকে দেখি তাকেই লাগে ভালো'।
ভাবলাম, দীর্ঘ ভ্রমণ সময়টা কাটবে ভালো। একবার মনে হল উড়োজাহাজ কোম্পানি হয়তো কোন কারণে যুবক যুবতীদের পাশাপাশি সিটের ব্যবস্থা করে। প্রথমবার আন্তর্জাতিক রুটে ভ্রমণ। কাল্পনিক চিন্তা ভাবনা মাথার ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকে।
আমার দিবাস্বপ্নে ছেদ পড়লো। শুরু হলো দুঃস্বপ্নের পালা। পিছন থেকে এক ছয় ফুট মধ্য বয়সী প্যাসেঞ্জার দৃশ্যপটে উদয় হলেন। শরীরটাও তাঁর মাশাল্লাহ সালমান খানের মতো সিক্স প্যাক। মুম্বাই ফিল্মের অমরেশ পুরির মত কিছুটা অনুরোধ কিছুটা হুমকি মিশিয়ে ভারী গলায় আদেশ করলেন, প্লেনের পিছনের দিকে আমার সিটটায় চলে যান, আমি আমার মেয়ের সাথে বসব।
আমি মনে মনে ভাবলাম, একেতো কষ্ট করে যোগাড় করা মনের মত সিট, তার উপরে এই তরুণীর সঙ্গ। আদেশ মত দুটোই ছেড়ে যেতে হবে? মামা বাড়ির আবদার আর কি!
আমার উপদেষ্টামন্ডলী সব বাড়িতে। এ অবস্থায় কি করা যায় তার জন্য কোন প্রেসক্রিপশন চাওয়ার সুযোগ নেই। হঠাৎ মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছি, নরমে গরম, গরমে নরম। সে আপ্তবাক্য স্মরণ করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম ছয় ফুট হোক কিংবা নয় ফুট, আমার সিট ছাড়বো না। তাতেই কাজ হল।
রূপকথার গল্পের মত damsel in distress, বিপন্ন বালিকাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে ছয় ফুট আমার প্রতি অগ্নিদৃষ্টি হেনে নিজের সিটে গিয়ে বসলেন।
ভেবে পেলাম না, 'ছয় ফুট' কেন আগেভাগে বেটা বেটি এক সঙ্গে বসার জন্য এম্বার্কেশন কার্ড নেননি। মনে পড়লো, দেশে বলতে শুনেছি, মানুষ যত লম্বা হয় তার বুদ্ধিশুদ্ধি কম হতে থাকে।
পরে জেনেছিলাম, তাঁরা সিলেটের শিক্ষিত পরিবারের লোক, লন্ডনে ভালো আয়-রোজগার আছে। কিন্তু উপমহাদেশের লোকজন যেখানেই যাক না কেন নিজেদের সংস্কার কিংবা কালচার ছাড়তে চায় না। সিলেটের রক্ষণশীল এলাকার লোকজনের তো কথাই নাই। সিলেটের মাঠে ঘাটে দেখা যায় মহিলাদের আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা। বাড়তি হিসেবে রোদ বৃষ্টি না থাকলেও মাথার উপরে ধরা থাকে একটা ছাতা।
আমর অনেক সাধনা করে পাওয়া সিটে বসে তরুনীর সাথে আলাপ জমানোর চিন্তা করে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখে-মুখে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মত ক্রোধ ঠিকরে পড়ছে। তার পিত্র দেবের সাথে বাহাস করার জন্য বেজায় নাখোশ। আমার আশা ভরসার উপরে পর্দা পড়ে গেল। কিন্তু ওদিকে নিয়তি আমদের দু'জনের জন্য একটা আলাদা স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছিল।
স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন এয়ার পকেটে পড়ে উথাল পাথাল ঝাঁকিয়ে সবার মনে ধরনীতলে আসন্ন পতনের ভীতি ঢুকিয়ে দিল। বাচ্চাদের চিৎকার, বড়দের দোয়া দরুদে, এয়ার ক্রদের দৌড়াদৌড়ি। সব মিলিয়ে মহা হুলুস্থুল কারবার।
এদিকে হট্টগোলের মাঝে 'ফুলের বনে যাকে দেখি ভালো লাগে সুন্দরী' জ্ঞান হারিয়ে আমার কাঁধের উপর আশ্রয় নিলেন। ইতোমধ্যে, প্লেনের কম্পন থেমে গেছে, কিন্তু সহযাত্রীর জ্ঞান ফেরেনি। পূর্ববৎ আমার কাঁধে হেলান দিয়ে বিস্মৃতির জগতে বিচরণ করে চলেছেন।
পাশ দিয়ে এয়ার হোস্টেস ট্রলি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রলি থেকে জলভর্তি গ্লাস তুলে এনে তার চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিলে আয়ত চক্ষু দুটি মেলে নিজেকে আমার কাঁধে আবিষ্কার করে একদিকে বিস্ময় অন্য দিকে লজ্জায় হতবাক। বনলতা সেনের পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে সিলেটি ভাষায় অস্ফুটে শুধালেন, আমার কিতা হয়েছিল?
--কিছু হয়নি একটুখানি হুশ হারিয়ে গিয়েছিলেন, এই আর কি।
--বলেনতো, আমার চোখে মুখে কি ছিটিয়েছেন। বড্ড আঠালো লাগছে; মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ।
এতক্ষণে আমারও হুশ হলো। গ্লাসে ছিল সেভেন আপ। পানির মতই দেখতে। আমার হাতও চটচটে লাগছে। পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে আলতো করে মুখ মুছে দিয়ে বললাম, ভুল হয়ে গেছে।
--আপনি কি টিস্যু পেপার সাথে নিয়ে ঘুরেন নাকি?
--শুধু টিস্যু পেপার না সুই, সুতা ব্লেড, নেল ক্লিপার, কাইচি সবই আমার ব্যাগে থাকে। এমনকি একটা চিমটিও থাকে।
প্রথমবারের মতো একটুখানি মুচকি হেসে বললেন, বড্ড মজার লোক তো।
--না হয়ে উপায় কি? কখন কাকে হুসে ফিরিয়ে আনতে হয় তা-কি বলা যায়? এই তো দেখেন, পানির বোতল ছিল না, সেজন্য আপনার সুন্দর মুখটা সেভেন আপ দিয়ে আঠালো বানিয়ে ফেললাম।
--এ পর্যন্ত কতজনকে হুসে এনেছেন?
--এবারই প্রথম, কিন্তু সত্যিকার হুসে আনতে পেরেছি কিনা বুঝতে পারছি না।
এ সময় ছয় ফুট এসে হাজির। আসতে এত দেরি হল কেন বুঝলাম না। বীরপুরুষ হয়ত নিজেই জ্ঞান হারিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর আদরের কন্যারত্নকে জিজ্ঞেস করলেন, তানিয়া, কিছু অসুবিধা হয়নি তো মা?
--তেমন কিছু না, একটু খানি জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম এই যা। এ ভদ্রলোক সেভেন আপ ছিটিয়ে হুস ফিরিয়ে এনেছেন।
--সেভেন আপ, সে কি কথা? না না ভালো কথা নয়। তুমি কি সিট বদল করতে চাও?
--না বাবা দরকার নেই, এখানে পা ছড়িয়ে বেশ আরামেই বসে আছি।
--তবুও সাবধানে থেকো।
একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে তিনি নিজের সিটের দিকে রওনা দিলেন।
এতক্ষণে সহযাত্রীর নাম জানা গেল। রক্ষণশীল পরিবারে রাশিয়ান নাম তানিয়া একটু অবাক করার ব্যাপার বটে।
পথে নিজেদের অল্পস্বল্প জীবনবৃত্তান্ত বিনিময় হলো। লন্ডনে নেমে বিদায় বেলা বললাম, আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।
ব্যস, উপায় বের করা গেল। নানা ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে বছর খানেকের মধ্যে তিনি আমার কাঁধে চিরকালের মতো আশ্রয় খুঁজে পেলেন। অতঃপর, রূপকথা থেকে ধার করে বলতে হয়, living happily ever after।
(এ গল্পটা বছর দেড়েক আগে Quora ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। লিংক নিচে দেয়া হল)।
sajidurrahaman publisher