Answered 2 years ago
প্রাচীন ও মধ্যযুগে অপরাধীদের যেসব কায়দায় শাস্তি ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো তা এককথায় অকল্পনীয়। এমন বীভৎস, নৃশংস, ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা এযুগের মানুষের কাছে অভাবনীয় লোমহর্ষক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ কতটা বোধশূন্য হলে, কতটা পাশবিক হলে, কতটা নির্মম হলে মানুষের উপর এমন বর্বরতা চালাতে পারে, তা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। নৃশংস শাস্তির অধিকাংশ জনসম্মুখে প্রদান করা হতো যাতে অন্যরা তা দেখে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। এখানে তারই কিছু উল্লেখযোগ্য নমুনা তুলে ধরা হলো।
১. লৌহকুমারী:
মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্যতম নিদর্শন লৌহকুমারী যন্ত্র। মানবাকৃতির লোহার এই বিশেষ খোলের ভিতরে চারপাশে তীক্ষ্ম ফলা সাঁটা থাকতো। বন্দীকে এর ভিতর ঢুকিয়ে খোলের দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হতো। চাপবৃদ্ধির সাথে সাথে বন্দী ফলায় বিদ্ধ হয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে মারা যেত। নুরেমবার্গে নির্মিত কুখ্যাত নুরেমবার্গ কুমারী এই মারণযন্ত্রের একটি দৃষ্টান্ত।
২. ক্যাথেরিনের চাকা:
এই পদ্ধতি অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, রোম, স্কটল্যান্ড, সুইডেন এবং উপমহাদেশের কোথাও কোথাও ব্যবহার করা হতো। বন্দীকে একটা কাঠের চাকার সাথে আঁটসাঁট করে বেঁধে লোহার রড দিয়ে আগাছে গোড়া পেটানো হতো। পিটিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় সব ভেঙ্গেচুরে দেওয়া হতো। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব ছিঁড়ে থেঁতলে দেওয়া হতো। একে ব্রেকিং হুইল পদ্ধতিও বলা হয়।
৩. ক্রুশ বিদ্ধ করা:
বন্দীকে ৩৫ থেকে ৬০ কেজি ওজনের ক্রুশটি নিজেই যথাস্থানে বয়ে নিয়ে যেতে হতো। তারপর সেই ক্রুশে বন্দীর হাত পা পেরেক দিয়ে গেঁথে ঝুলিয়ে রাখা হতো। নির্যাতিতের সমস্ত শরীরের ওজন পেরেক গাঁথা হাতের উপর পড়তো। সে রক্তক্ষরণ, সূর্যতাপ, চাপ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও শ্বাসকষ্টের শিকার হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে মারা যেত। আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা ক্রুশ আবিষ্কার করেছিল। পরবর্তীতে পার্সীয়, ফিনিশীয় ও রোমানরা এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
৪. ব্রাজেন বুল:
সিসিলিতে সর্বপ্রথম এই পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে একে সিসিলীয় ষাঁড়ও বলা হয়। প্রাচীন গ্রীকরা এরকম পিতলের ষাঁড়ের ডিজাইন করেছিল। এ পদ্ধতিতে প্রমাণ আকারের একটি পিতলের ষাঁড় বানানো হতো যার ভিতরটা পুরোই ফোপা থাকতো। ষাঁড়ের পিঠ দিয়ে পেটে ঢোকার দরজা রাখা হতো। বন্দীকে ষাঁড়ের ভিতর ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ধাতব ষাঁড়ের পেটের নিচে আগুন জ্বালানো হতো। ফলস্বরূপ, ভিকটিম জীবন্ত কাবাবে পরিণত হতো। এই ব্রাজেন বুলের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, আগুনের প্রচণ্ড তাপে ভিতরে ভিকটিম যে আর্তনাদ করতো, সে আর্তনাদ ষাঁড়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতো। ষাঁড়টার মুখে এমন বাদ্যযন্ত্র স্থাপন করা হতো যাতে নির্যাতিতদের আর্তনাদ সত্যিকার ষাঁড়ের গর্জনের মতো শোনায়। উপস্থিত গণ্যমান্যরা উৎসবে ভোজ খেত আর এমন গর্জনে বিনোদন উপভোগ করতো।
৫. রোমান মোমবাতি:
যেসব নিষ্ঠুর রোমান শাসক এই পদ্ধতির চর্চা করতো, তন্মধ্যে সম্রাট নিরো অন্যতম। ভোজ উৎসবের আয়োজনে জীবন্ত মানুষকে মোমবাতি বানিয়ে পোড়ানোর রীতি ছিল রোমে। অভিযুক্তর হাত পা পেরেক দিয়ে শক্ত করে আটকে দেওয়া হতো একটি কাঠামোর সাথে। তারপর দাহ্য পদার্থ দিয়ে তার আপাদমস্তক ভিজিয়ে দেওয়া হতো। অবশেষে, উল্টো করে ঝোলানো মানুষটার পায়ের দিকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মোমবাতির মতো করে জ্বালানো হতো। ইতিহাসে সম্রাট নিরোর এহেন নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই এই পদ্ধতিকে নিরোর টর্চও বলা হয়।
৬. সম্পীড়ন যন্ত্র:
বিশেষ করে জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য উদ্ধারের উপায় হিসেবে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হতো এশিয়ার কিছু অঞ্চল এবং ইউরোপে। অভিযুক্তকে তীব্র কষ্টের মধ্য দিয়ে মৃত্যু বরণ করতে হতো। আয়াতাকার কাঠের ফ্রেমের উপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শোয়ানো হতো। তারপর ফ্রেমের দুই পাশের দুটি কাঠের রোলারে হাত পা দড়ি দিয়ে টেনে বাঁধা হতো। রোলারের সাথে যুক্ত লিভারের সাহায্যে এবার ধীরে ধীরে অভিযুক্তের দেহকে টেনে সম্প্রসারণ করা হতো। এক পর্যায়ে শরীরের কশেরুকা, পেশি, রগ, হাড়ের জোড়া ছিঁড়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি মারা যেত।
৭. শূলে চড়ানো:
শূল আরেকটা বীভৎস যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি। সাধারণত দেশদ্রোহীতা ও গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। তীক্ষ্ম একটি লোহার ফলা অপরাধীর পশ্চাৎদেশ দিয়ে ঢুকিয়ে ফলাটা লম্বালম্বিভাবে মাটিতে পুঁতে রাখা হতো। ভিকটিমের নিজের ভারেই নিজের শরীর ধীরে ধীরে গেঁথে নিচে নেমে আসতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যন্ত্রণা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ফলার আগা তীক্ষ্ম না করে ভোঁতা করে দেওয়া হতো। এতে করে ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, কলিজার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো খুব ধীরে বিদ্ধ হতো এবং মৃত্যুযন্ত্রণা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছত। এভাবে মৃত্যু হতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগতো। প্রাচীন মিশর, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, নিকটপ্রাচ্য ও ইউরোপে শূলে চড়ানো পদ্ধতি বেশ সুপরিচিত ছিল।
৮. জীবন্ত পুড়িয়ে বা সিদ্ধ করে মারা:
এই পদ্ধতিতে নারীদেরকে ডাইনি অ্যাখ্যা দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। পুরুষদেরকেও কখনো কখনো এভাবে পুড়িয়ে মারা হতো। ফ্রান্সের বীরাঙ্গনা জোয়ান অব আর্ককে ডাইনি অ্যাখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনা বিশ্বব্যাপী আজও আলোড়ন সৃষ্টিকারী সত্য ঘটনা হয়ে রয়ে গেছে। আবার ফুটন্ত পানি, তেল অথবা আলকাতরায় চুবিয়ে জীবন্ত সিদ্ধ করার রীতি ছিল এশিয়া ও ইউরোপের কিছু অঞ্চলে।
৯. হাতি দিয়ে মাড়ানো:
প্রাচীন ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার হাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে এই পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতি ভিকটিমের মাথার উপর পা দিয়ে ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে মাথা থেঁতলে দিত। আবার হাতি দিয়ে সরাসরি খচিয়ে মাড়িয়ে মারার ব্যবস্থাও ছিল।
১০. জীবন্ত চামড়া ছেলা:
প্রথমে হাত পা কষে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর ধারালো ব্লেড দিয়ে ধীরে ধীরে জীবন্ত ব্যক্তির শরীর থেকে চামড়া তুলে নেওয়া হতো। কখনো কখনো চামড়া ছেলার সুবিধার্থে ভিকটিমের শরীরের কিছু কিছু অংশ গরম পানি দিয়ে মোলায়েম করে নেওয়া হয়। চামড়ার সাথে অল্পবিস্তর মাংসও তুলে নেওয়া হতো এবং যন্ত্রণার মাত্রা বৃদ্ধির জন্য কখনো ছেলা অংশে লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হতো। কাঁপুনি, রক্ত ও ফ্লুয়িডের অতি ক্ষরণে ভিকটিমের মৃত্যু ঘটত। এভাবে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। জীবন্ত চামড়া ছেলা পদ্ধতি আসিরীয়, অ্যাজটেক, চীনা ও মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়দের মধ্যে বেশি চর্চিত হতো। চামড়া ছেলার আদি নিদর্শনের খোঁজ মেলে নয়া আসিরীয় সাম্রাজ্যে—৮৮৩ থেকে ৮৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
১১. রক্ত-ঈগল:
জলদস্যুদের নৃশংস হত্যাকান্ডের এক চরম দৃষ্টান্ত রক্ত-ঈগল। এই পদ্ধতি এতটাই অবিশ্বাস্য যে বিতর্ক রয়েছে এমনভাবে নরহত্যা আদৌ সম্ভব কিনা। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের একটি দল নিশ্চিত করেছেন, হ্যাঁ, এটা অ্যানাটমিক্যালি সম্ভব। সাধারণত জলদস্যুরা তাদের চরম শত্রুর উপর এভাবে প্রতিশোধ নিত। প্রথমে বন্দীর পিঠ ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেড়ে নেওয়া হতো। এরপর পাঁজরের হাড়গুলো মেরুদণ্ড থেকে একে একে বিচ্ছিন্ন করা হতো। ফুসফুস পিঠ দিয়ে টেনে বের করে ফেলা হতো। পাঁজরের হাড়গুলো একে একে পিঠের মাংস ফুড়ে উল্টো করে বের করা হতো। হাড়গুলো পিঠের উপর এমন শিল্পিতরূপে সাজিয়ে রাখা হতো দেখে যেন মনে হয় পাখির ডানা গজিয়েছে। এজন্য এ পদ্ধতির নাম রক্ত-ঈগল। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে জলদস্যুরা ইংল্যান্ডের নর্থাম্ব্রিয়ার রাজা অ্যালেকে ৮৬৭ সালে এভাবে হত্যা করেছিল বলে কথিত আছে।
১২. করাত দিয়ে চেরা:
পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে করাত পদ্ধতির প্রচলন ছিল। ধর্মকেন্দ্রিক অপরাধের যেমন সমকামিতা প্রভৃতির শাস্তি বিধানের নামে অভিযুক্তকে করাত দিয়ে চিরে দুইভাগে ভাগ করা হতো। সাধারণত জনসম্মুখে এভাবে চেরা হতো যাতে অন্যরা সাবধান হতে পারে। গোলপোস্টের মতো কাঠামোতে ভিকটিমকে উল্টো করে ঝুলিয়ে বাঁধা হতো। এরপর স্রেফ করাত দিয়ে দুইজন করাতি তাকে চিরে ফেলত।
যুগে যুগে অগণিত দুর্ভাগা মানুষদেরকে যে সীমাহীন নরকযন্ত্রণার মাধ্যমে প্রাণ ত্যাগ করতে হয়েছিল, তা মোটেও তাদের প্রাপ্য ছিল না, যদি তারা মারাত্মক অপরাধও করে থাকে। সমকালের মানুষের কাছে অপরাধীর জন্য যা ন্যায্য শাস্তি, পরবর্তী কালের মানুষের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য নিষ্ঠুর শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেমন একালের অনেক শাস্তি পরবর্তী কালের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সন্দেহ।
16.5 হা বার দেখা হয়েছে
213টি আপভোট দেখুন
12টি শেয়ার দেখুন
মুহাঃ রিদওয়ান তানিম-এর প্রোফাইল ফটো
মুহাঃ রিদওয়ান তানিম
·
অনুসরণ
অতিতসমাজ ব্যবস্থা ও বর্তমানসমাজ ব্যবস্থার পার্থক্য বিশ্লেষণ 20 অক্টোবর
"জীবন্ত চামড়া তুলে নেয়ার শাস্তি !!! ”
বর্তমান ইরাকের পূর্বসূরী আসেরীয়রা বা মেক্সিকোর এযটেকরা এই প্রথায় শাস্তি দিত। মধ্যযুগে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সেও এইধরনের শাস্তি দেয়া হত।মধ্যযুগে ১৩০০-১৪০০ সালের দিকে এই ধরনের রেওয়াজ ছিল। বন্দিকে জীবন্ত রেখে ত্বকের সমগ্র শরীর থেকে চামড়া অপসারণ করা হত। এটি ছিল একটি প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড প্রদান সার্বজনীন পদ্ধতি । মাঝে মাঝে ব্যাথার তীব্রতা বাড়ানোর জন্য লবণ মাখানো হত। এই ভাবে অশেষ যন্ত্রনা ভোগ করে বন্দি মারা যেত।
©
(বি:দ্র: যদি ভালো লাগে তাহলে আপভোট দিয়ে এবং অনুসরণ করে পাশে থাকবেন, ধন্যবাদ। )
suriyasultana publisher