পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ-এর বাপ-দাদারা ছিলেন হিন্দু। এটি নিয়ে কেউ বিস্তারিত বলবেন কি?

1 Answers   3.3 K

Answered 2 years ago

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (২৫ ডিসেম্বর ১৮৭৬ – ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) সিন্ধু প্রদেশে বন্দরনগরীর করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন।


ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ শুধু নয় হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্তির তত্ত্ব হাজির করেছিলেন তিনি। এ তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান নামের এক অদ্ভুত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেখান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আমাদের আজকের বাংলাদেশও ছিল শুরুতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ। পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে তখন অভিহিত করা হতো আমাদের এই দেশটিকে। পাকিস্তানের অপর অংশ পশ্চিম পাকিস্তান ছিল তেরোশ মাইল দূরে। দুই দেশের মাঝে ভারত নামের বিশাল এক দেশের অবস্থান। ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে অন্য কোনো দিক থেকে মিল ছিল না বললেই চলে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে সময়ের শীর্ষ আইনজীবী ও তুখোড় রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হলেও ব্যক্তিজীবনের দিকে আলোকপাত হয়েছে খুবই কম।

তিনি যা নন, সেভাবে তাকে উপস্থাপনের চেষ্টা চলেছে জিন্নাহ সমর্থক এবং জিন্নাহ বিরোধীদের পক্ষ থেকে। জিন্নাহকে অপদেবতা বা দানব বানানোর চেষ্টা করেছেন বিদ্বেষ ভাবাপন্নরা। আবার অন্ধ সমর্থকরা তাকে প্রকারান্তরে ফেরেশতা কিংবা দেবদূতের মতো ভুলত্রুটিমুক্ত সত্তা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। জিন্নাহর একমাত্র কন্যা দিনা পাকিস্তানে যেভাবে তার বাবার বন্দনা করা হয় তাতে বিরক্ত প্রকাশ করেছেন এক সাক্ষাৎকারে।

জিন্নাহ পরিবার সেই ব্রিটিশ আমলে করাচিতে বসতি গড়লেও তাদের আদি বাড়ি ভারতের গুজরাটে। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী জিন্নাহরা উনিশ শতকে গুজরাটের কাথিরাড় থেকে করাচিতে চলে আসেন। তার পিতামহ ছিলেন নিরামিষভোজী হিন্দু সম্প্রদায় লোহানা গোত্রের সদস্য। তিনি মাছের ব্যবসা করে এলাকার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। লোহানা গোত্রের কেউ আমিষ অর্থাৎ মাছের ব্যবসা করবে তা মেনে নিতে পারেনি ওই সম্প্রদায়ের সমাজপতিরা। তারা জিন্নাহর পিতামহকে সপরিবারে সমাজচ্যুত করে। বাধ্য হয়ে তিনি মাছের ব্যবসা বাদ দিয়ে নিজ সমাজে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু সমাজপতিরা তাতে রাজি হননি। ফলে তার পুত্র পুঞ্জলাল ঠাক্কুর অর্থাৎ জিন্নাহর পিতা চার ছেলেসহ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেন। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী জিন্নাহ জন্মগ্রহণ করেন হিন্দু পরিবারে। তার বাবা সন্তানদের নিয়ে ধর্মান্তরিত হলে জিন্নাহও মুসলমান হয়ে যান। শিয়া ইসমাইলি ফেরকার ইসলাম গ্রহণ করেন তারা। উল্লেখ্য, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের মুসলমানরা খোজা নামে পরিচিত।

ইসমাইলি সম্প্রদায় কয়েকশ বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম শান্তিবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশে গুপ্তহত্যা এবং রোমহর্ষক হিংসাত্মক কর্মকা- জড়িত। ইসলামের শিয়া মতাবলম্বীদের মধ্য থেকে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের উদ্ভব। শিয়ারা হজরত আলী (রা.)-কে তাদের ইমাম বলে মনে করেন। ইমাম শব্দের অর্থ নেতা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আধ্যাত্মিক নেতা। হজরত আলীর (রা.) পর ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল সাদিক পর্যন্ত সব ইমামকে ইসমাইলীয়রা স্বীকার করলেও সপ্তম ইমাম হিসেবে মুসা কাজিমকে স্বীকার না করে তার ভাই ইসমাইলকে ইমাম হিসেবে তারা মান্য করেন। স্মর্তব্য, ইমাম জাফর আল সাদিকের পর ইসমাইলেরই ইমাম হওয়ার কথা। কিন্তু বাবার জীবিতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে ইমাম জাফর আল সাদিক আরেক পুত্র মুসা কাজিমকে পরবর্তী ইমাম হিসেবে মনোনয়ন দেন। ইসমাইলের সমর্থকরা এটি মেনে নিতে পারেননি। ফলে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি আসে। ইসমাইল সমর্থকদের বিশ্বাস, তাদের ইমাম গায়েব হয়ে আছেন এবং যে কোনো সময় পাপাচারে নিমজ্জিত সমাজ সংস্কারে তিনি ইমাম মাহাদি রূপে আবির্ভূত হবেন। অন্যদিকে শিয়া সম্প্রদায়ের অন্য অংশ পরিচিত দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী হিসেবে। তারা বিশ্বাস করেন মুসা কাজিম সপ্তম ইমাম এবং দ্বাদশ ইমাম আবির্ভূত হবেন ইমাম মাহাদি নামে।

ইসমাইলীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাস আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম হলেন ইমামরা। সম্মানিত ইমামদের মাধ্যমে এবং তাদের অনুসারীরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অর্জন করে।

ইসমাইলীয় সম্প্রদায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় গুপ্ত হত্যাসহ যে নৃশংসতার আশ্রয় নেয় তা ইতিহাসের একটি সমালোচিত অধ্যায়। ১৮৪০ সালে ইসমাইলিদের মধ্য থেকে একটি বড় অংশ আগা খানের নেতৃত্বে আলাদা ধর্মীয় গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। এ সম্প্রদায়ের ইমাম আগা খান ইরান থেকে ভারতের মুম্বাই নগরীতে এসে ঠাঁই নেন।

ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতাও পান তারা। ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের তৃতীয় ইমাম সুলতান মুহাম্মদ শাহ আগা খান ১৮৮৫ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে ইমামতি প্রাপ্ত হন। ৭৭ বছর যাবৎ তিনি ছিলেন ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা বা ইমাম। মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতিও ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সম্রাটের কাছ থেকে নাইটহুডে ভূষিত হন তৃতীয় আগা খান। প্রথম মহাযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত জাতিপুঞ্জ বা লিগ অব নেসন্সের সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৩৪ থেকে ৩৮ সাল পর্যন্ত।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে আগা খানের নেতৃত্বাধীন ইসমাইলীয় জামাতের কয়েক লাখ সদস্য রয়েছে। এ সম্প্রদায়ের সদস্যরা নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেন। তারা নামাজ রোজা এবং অন্যান্য ধর্মাচারও পালন করেন। মসজিদের বদলে তারা উপাসনার জন্য যান জামাতখানায়। সেখানে তারা কোরআন পাঠ ও নামাজ আদায় করেন।

ইসমাইলীয় সম্প্রদায়ের বিকাশের সঙ্গে গুপ্তহত্যা এবং সন্ত্রাসের রোমহর্ষক সম্পর্ক থাকলেও স্বীকার করতে হবে ইসমাইলীয়রা এখন পৃথিবীর অন্যতম শান্তিবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বাবা ইসমাইলীয় ফেরকার ইসলাম গ্রহণ করলেও ভারতীয় উপ-মহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমানদের অনেকে এ সম্প্রদায়কে মুসলমান বলে স্বীকার করতেও নারাজ। এমনকি শিয়ারাও ইসমাইলীয় বিশেষ করে আগা খানের নেতৃত্বাধীন ইসমাইলীয় সম্প্রদায়কে বাঁকা চোখে দেখে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ইসমাইলীয় সম্প্রদায়ের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে দেশের রাষ্ট্র পিতা জিন্নাহ ছিলেন ইসমাইলীয় সম্প্রদায়ের সদস্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যে দলটি নেতৃত্ব দেয় সেই মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন ইসমাইলীয় সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা তৃতীয় আগা খান। জিন্নাহ পরিবার হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে শিয়া ইসমাইলীয় ফেরকার ইসলাম গ্রহণ করলেও পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা তাদের বিশ্বাস শিয়া ইসলামের দিকে নিয়ে যায়।

Akhi Khatun
akhikhatun
267 Points

Popular Questions