সম্রাট আকবরের স্ত্রী যোধাবাঈ একজন পর্তুগিজ মহিলা ছিলেন, যার প্রকৃত নাম ছিল ডোনা মারিয়া মাসকারেনহাস। লেখক লুইস ডি অ্যাসিস কোরিয়া তাঁর "পর্তুগিজ ইন্ডিয়া এবং মুঘল সম্পর্ক ১৫১০-১৭৩৫" বইয়ে দাবি করেছেন।[1] ২০১৭ সালে ভারতের প্রথম সারির অনেকগুলো পত্রিকা এই নিয়ে রিপোর্ট করে।
পর্তুগিজদের ব্যাপক প্রভাব আছে উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে। ভারতের গোয়া ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের দখলে ছিল। ইউরোপে পর্তুগিজরাই প্রথম ভারতে সরাসরি সমুদ্রের পথ আবিষ্কার করেছিল। ২০ মে, ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর ক্যালিকট পৌঁছেছিলেন। তবে ইউরোপীয় পর্যটকেরা আরো আগে থেকেই ভারতে এসেছেন।
মুর নাবিক আহমদ ইবনে মজিদ ভাস্কো দা গামাকে আফ্রিকা থেকে ভারতে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন। (তবে পণ্ডিত জি.আর. তিব্বত, এই দাবির বিরোধিতা করেন।) ইবনে মাজিদ সমুদ্রের সিংহ নামে পরিচিত ছিলেন।
বাংলায় পর্তুগিজদের তিনটি প্রধান বাণিজ্য পয়েন্ট ছিল
চট্টগ্রাম: পোর্তো গ্র্যান্ড বা গ্রেট হ্যাভেন: পর্তুগিজরা যখন বাংলায় আসে তখন চট্টগ্রাম ছিল প্রধান বন্দর এবং রাজধানী গৌড়ের প্রধান প্রবেশদ্বার। গৌড়ের প্রধান পথ ছিল মেঘনা।
সপ্তগ্রাম: লিটল হারবার বা লিটল হ্যাভেন: সাতগাঁও ছিল সপ্তগ্রাম যা ছিল সরস্বতী নদীর তীরে সাতটি গ্রাম নিয়ে গঠিত। এমন সময় ছিল যখন ঢাকার মসলিন সাতগাঁও থেকে মিশরের মধ্য দিয়ে রোমে যেত। মসলিন খুব প্রশংসা এবং দুর্দান্ত দাম পেয়েছিল।
হুগলি বা ব্যান্ডেল
১৫১৭ সাল থেকে ভারতের গোয়া থেকে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা সমুদ্রপথে বাংলায় যাত্রা শুরু করে। জোয়াও ডি সিলভারিয়া পরিচালিত চারটি জাহাজের একটি বহর ৯ মে ১৫১৮ সালে চট্টগ্রামে নোঙর করে। ১৫৩৭ সালে তাদের চট্টগ্রামে (xetigam) বাণিজ্য পোস্ট স্থাপনের অনুমতি দেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ, এর পিছনে আছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তীরে পর্তুগিজরা ফিরিঙ্গি বন্দর গড়ে তোলে। ১৬০৭ সালে তারা স্বন্দীপ(sundiva) দখলে করে, পরে আরাকান রাজা তাদের পরাজিত করে। মগদের সাথে মিলে পর্তুগিজরা চরম লুটতরাজ চালায় চট্টগ্রামের আশেপাশের এলাকায়।
চট্টগ্রামের মহসিন কলেজের পাহাড়ে ভগ্নপ্রায় পর্তুগিজ ভবন। [2]
জোয়াও ডি সিলভারিয়া বাংলায় আসা প্রথম পর্তুগিজ ছিলেন না, জোয়াও কোহেলো সিলভারিয়ার আগে চট্টগ্রামে ছিলেন এবং অনেক পর্তুগিজ মুরিশ জাহাজে ব্যবসায়ী হিসাবে বাংলায় এসেছিলেন। এছাড়াও, যারা ১৫১৪ সালে ঊড়িষ্যায় বসতি স্থাপন করেছিল, তারা একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন।
১৫৭৯-৮০ সালে সম্রাট আকবর একটি পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন পেদ্রো তাভারেসকে বঙ্গদেশ প্রদেশের যে কোনও জায়গায় একটি শহর স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। তারা হুগলিকে বেছে নিয়েছিল এবং এভাবে হুগলি বাংলায় প্রথম ইউরোপীয় বসতিতে পরিণত হয়। ১৫৯৯ সালে, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা হুগলির ব্যান্ডেলে একটি কনভেন্ট এবং একটি চার্চ তৈরি করেছিল।
ব্যান্ডেল চার্চ নামে পরিচিত বেসিলিকা অব দ্য হলি রোজারির ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্টান গীর্জা।
পর্তুগিজরা যে এদেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করেছেন, সন্দেহ নেই। পাদ্রী, গির্জা শব্দগুলো পর্তুগিজ। আনারস, আলপিন, আলমারি, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, বালতি ইত্যাদি শব্দগুলো পর্তুগিজ। বলতে পারেন, ''এসবতো ইশকুলেই শিখেছি।'' উইকিপিডিয়ায় বাংলা ভাষায় পর্তুগিজ শব্দের তালিকাটি চাইলে আপনিও সম্পাদনা করতে পারেন। বর্তমান ভারতীয় ভাষাগুলিতে অনেক পর্তুগিজ শব্দ রয়েছে, যার বেশিরভাগই বাণিজ্য বা খ্রিস্টান ধর্মের সাথে যুক্ত, বা ইউরোপ থেকে আমদানি করা প্রচলিত ব্যবহারের জিনিসের নাম।ভোকাবোলারিও ইমেডিয়ো বেঙ্গললা, পর্তুগিজ লেখক মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও এর এই বইটা রোমান হরফে লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ বই, ১৭৪৩ সালে এটা প্রকাশিত হয়। তবে মুদ্রণ জগতে প্রথম বাংলা লিপি ব্যবহার করে ব্যাকরণ বই লিখেছেন একজন ইংরেজ, ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড, প্রকাশিত হয়েছে ১৭৭৮ সালে।
পর্তুগিজরা দারুণ বিলাসে বাস করত, স্থানীয় নবাবদের স্টাইলে পোশাক পরত। তাদের অন্যতম বিশেষত্ব ছিল আম, কমলা, লেবু, আদা থেকে আচার আর মিষ্টি তৈরি করা। পর্তুগিজ বেকাররা তাদের রুটি, কেক এবং বিভিন্ন প্রকারের প্যাস্ট্রিগুলির জন্যও পরিচিত ছিল। আমাদের দেশের প্রচলিত মিষ্টির অনেকগুলোই পর্তুগিজদের কাছে শেখা। এমনকি এর মধ্যে আছে সন্দেশ আর রসমালাইয়ের নামও। পর্তুগিজরা এদেশে এনেছে অনারস, আলু, পেঁপে, টমেটো, পেয়ারা আরো অনেক ফল আর সবজি।
কবি আলাওলের কবিতায় আমরা শুনি হার্মাদদের কথা।
কার্যগতি যাইতে পথে বিধির গঠন।
হার্মাদের নৌকা সঙ্গে হৈল দরশন।।
হার্মাদ কারা? হার্মাদ শব্দটা এসেছে পর্তুগিজ আর্মাডা শব্দ থেকে। আর্মাডা মানে যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু এদেশে হার্মাদ বলতে জলদস্যুদের বোঝানো হতো। আরাকানের মগ দস্যুরা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৎকালীন মোগল-শাসনাধীন বাংলায় সীমাহীন লুন্ঠন চালিয়েছিল। ওরাই হার্মাদ। বর্গীদের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না। বর্গীরা ছিল মারাঠি দস্যু। হার্মাদরা আলাওলের পিতাকে হত্যা করে। জোয়াকিম জোসেফ এ ক্যাম্পোস বাংলায় পর্তুগিজদের ইতিহাস লিখতে যেয়ে লিখেছেন, যারা আরাকানীদের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিল, তারা হুগলির পর্তুগিজ ছিল না; তারা গোয়া এবং অন্যান্য স্থান থেকে আগত এবং পলাতক ছিল। গোয়ায় এবং হুগলিতে তাদের নিজস্ব ভাইরা তাদের স্বীকৃতি দেয় নি।
বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার নামের সাথে মিশে আছে পর্তুগিজদের কথা। জেলার পার্শ্ববর্তী খাল ধরে দস্যুতা করত পর্তুগিজরা। পর্তুগিজ আর খাল, এই দু'য়ে মিলে পটুয়াখালী নামের উৎপত্তি বলে কথিত আছে। নদীর জালে বোনা দক্ষিণবঙ্গে পর্তুগিজদের মতো সমুদ্রপথে আগত মানুষদের চলাচল সহজ ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলার এই ভৌগলিক চরিত্রটি জলদস্যুতা ও লুণ্ঠনের ভয়ঙ্কর থিম রচনা করে।
যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য পর্তুগিজদের কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁর নৌবাহিনীতে। বারো ভূঁইয়ার একজন ছিলেন তিনি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘলদের বিপক্ষে পর্তুগিজরা প্রতাপাদিত্যের সৈনিক হয়ে লড়াই করে। সেই আমলে প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধজাহাজ ছিল মুঘলদের প্রায় দ্বিগুন। প্রথম প্রথম জাহাজগুলোর দায়িত্ব বাঙালিদের হাতে থাকলেও পরে পর্তুগিজদের হাতে তুলে দেন। পর্তুগিজরা যেমন জলদস্যুতায় কুখ্যাত ছিল তেমনই ছিল শ্রেষ্ট নাবিক ও নৌযোদ্ধা।
কলকাতায় পর্তুগিজ চার্চ, ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[3]
পর্তুগিজরা যখন হুগলিতে অন্যায় রূপে প্রবল হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছিল, তখন ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট সাজাহান সৈন্য পাঠিয়ে দেন তাদের উৎখাত করবার জন্যে। মোগল সাম্রাজ্যের সেই পূর্ণগৌরবের যুগেও পর্তুগিজরা সহজে বাগ মানেনি। জলপথে ও স্থলপথে মোগলদের তারা প্রাণপণে বাধা দেয়। প্রায় তিন মাস ধরে লড়াই করে মোগলদের ঠেকিয়ে রেখে অবশেষে পর্তুগিজরা পরাজয় স্বীকার করে। তাদের বন্দি করে আগ্রায় সাজাহানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দিদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশই ভোগ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই ব্যাপারের পর থেকে বাংলা দেশে শক্তি হিসাবে পর্তুগিজদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙে যায়।
chamok publisher