ছাত্রাবস্থায় আপনার কোনো প্রশ্ন কি কখনো আপনার শিক্ষককে অপ্রস্তুত বা বিব্রত করেছিল? কেন?

1 Answers   8.8 K

Answered 2 years ago

নমস্কার!


প্রশ্নটি করেছেন আত্মজা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়া, আমার স্কুল-ছাত্র জীবনের একটি ঘটনা দিয়েই তার উত্তর দিলাম।


ছাত্রাবস্থায় আমি কেমন স্বভাবের ছিলাম তাই আগে বলি, দেখবেন প্রত্যেক শ্রেণীতেই নীরব, ভাবনা বিহ্বল ও শান্ত স্বভাবের দু-চার জন ছেলে-মেয়ে থাকেই, যারা একান্ত প্রয়োজন ছাড়া তেমন উচ্য-বাচ্য করেনা, সবার কথা বা বক্তব্য মন দিয়ে শোনে বা শুনতেই পছন্দ করে।


(অবশ্য তার মানে এই নয় যে তারা কোনও ভুল বক্তব্যও মেনে নেয় , তা কিন্তু একদমই না উল্টে তারা ভদ্রতার সঙ্গেই প্রতিবাদ করে বা বিরোধীতা করে ভুল মন্তব্যের।)


তাদের শ্রেণী কক্ষে হাতে গোনা দুই-এক জনের সাথেই অল্পবিস্তর হাসি ঠাট্টা বা গল্প হয় তাইবলে এমন নয় যে তারা ক্লাসের অন্যদের পছন্দ করেনা, সবাইকেই এরা লক্ষ করে কিন্তু নিজে এদের কর্মকান্ডে তেমন ভাবে যোগ দিতে পারেনা বা উৎসাহ পায়না, এটাই পার্থক্য। অথচ, সরস্বতী পূজার সময় এরা কিন্তু সবার সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, তখন কিন্তু সবাই এদের কাছে আপনার, কেউ ফেলনা নয়।


আমি ঠিক ঐ ধরনেরই ছিলাম বিদ্যালয়ে শিক্ষার বছর গুলোতে, আর সত্যি বলতে কি আজও মনের দিকে তেমনই আছি কেবল এখন একটু বেশি কথা বলি আগের চেয়ে এই যা।


স্কুলে আমি টিফিন টাইমে একা ক্লাসে বসে থাকতাম আর গান গাইতাম! নিজের গানের সুরে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যেতাম!


বিদ্যালয়ের বাৎসরিক অনুষ্ঠাণে আমি "প্রধান গায়ক" হিসেবে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান গাইতাম, কখনও বা রবীন্দ্র সঙ্গীত, স্কুল ছাত্র দের মধ্যে আমি গায়ক নামে পরিচিত ছিলাম।


আমাদের স্কুলে তখন মাত্র একজনই শিক্ষিকা ছিলেন আর উনি ছিলেন বিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি পপুলার ও সন্মানপ্রাপ্তা একথা আমি অন্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহাশয়দের ছোট না করেই বলছি।


আসলে R.D.C ম্যাডামকে সবছাত্রই ভয় পেতো এবং সমীহ করে চলত এমনি ওনার ব্যাক্তিত্ব! পেশার প্রতি এমন নিষ্ঠা সহজে চোখে পড়েনা।


একদিন ইতিহাস প্রিয়ডে ওনার ক্লাসে অনেকেই পড়া করে আসেনি দেখে উনি শুধু বলেছিলেন যে " আমি বোধ হয় তোমাদের ঠিক করে বোঝাতে পারিনি " ব্যাস , এটুকু বলেই উনি চুপচাপ চলে গেলেন নিজের কক্ষে, আমরা চুপি চুপি জানালার আড়াল দিয়ে দেখেছিলাম উনি দুহাতে মাথা চেঁপে বসে আছেন , আর দুচোঁখ বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে!


সে দিনই আমরা দুই প্রিয়ড বসে পড়া করে ওনাকে দিয়েছিলাম আর ক্ষমা চেয়েছিলাম! এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষক, শিক্ষিকা যাদের জন্য আজও গর্ব বোধ হয়, এখনও পথে ঘাটে, বাজারে যেখানেই দেখি প্রণাম করতে ভুলিনা, ওনারা হলেন এক একজন রত্ন, আহা কি প্রজ্ঞা, কত জ্ঞান ওনাদের।


ভাবছেন, আমি প্রশ্ন গুলিয়ে ফেলেছি বা অযথা প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি ? একদমই না, কেন যে মূল ঘটনার পূর্বে এই বিদ্যালয় ও আমার স্বভাব সম্পর্কে আপনাদের অবগত করাচ্ছি তা পরে ঠিক বুঝবেন।


যাইহোক, এখানে বলে রাখি যে আমাদের বিদ্যালয়ে পোশাক বিধি কঠোর ভাবে মান্য করা হতো এছাড়াও বিদ্যালয়ে প্রবেশেরও নির্দিষ্ট সময় সীমা ছিলো ফলে প্রায়সই আমাদের শাস্তির মুখে পরতে হতো!


এবার মূল ঘটনায় আসি।


আমাদের ক্লাসে কিছু বিচ্ছু ধরণের বেয়াদপ ছাত্র ছিল এরা বাচালের শিরোমণি এক একজন, যেমন দুরন্ত তেমনি অমনোযোগী, ছাত্র হিসেবেও লাড্ডু, আর সাংঘাতিক রকম কূট, কোলাহল অশান্তি প্রিয়, মারামারি হুড়োহুড়ি, এর চুলটানা ওর বই লুকানো, অশোভণ ভাষার ব্যাবহার, মোদ্দাকথা যতরকম উশৃঙ্খলতা আছে তা সবই এদের অভ্যাস।


(কিছু কিছু হাওয়া খোর ব্যাক্তি আবার এদেরকেই নাকি দেশের ভবিষ্যত বলে বর্ণনা করে থাকেন!)


এহেন অবস্থায় আমরা ঐ দুর্দান্ত ছেলেদের যথাসম্ভব এড়িয়েই চলতাম এবং যখন তখন এই উৎপাত সহ্য করেও চুপ করেই থাকতাম কারণ অনেক বার ভালো ভাবে বোঝানোতেও এরা শুনতো না বরং আরও বেশি উপদ্রব শুরু করত। কি আর করব শ্রেণি শিক্ষক কে বললে দুজন কেই বেঁত্রাঘাত করবেন, কিছু না করেও কেন শুধু শুধু বেঁত খাবো? এই কথা ভেবেও চুপ করে থাকতাম, এমনি করেই বছর গুলো কাটছিল।


দশম শ্রেণীতে তখন, টেস্টের রেজাল্ট এসেছে, স্কুলে তখন স্যার দের তত্ত্বাবধনে আমাদের জন্য বিশেষ ক্লাস দেওয়া হয়েছে (বোর্ডের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি ক্লাস)।


যথা সময়ে বিদ্যালয় গৃহে আমরা উপস্থিত হয়েছি, এমন সময় হঠাৎ শুরু হল সেই পুরনো অত্যাচার! আমার হাত থেকে বিজ্ঞানের খাতা টেনে নিয়ে পটা পট আট দশটা পৃষ্ঠা ছিড়ে নিল তার পর শুরু করল কাগজ ছোড়াছুড়ি।


সেদিন হঠাৎ আমার মধ্যে কি যেন হয়ে গেল, বোধ করি দীর্ঘ্য দিনের ছাইচাপা আগুন হঠাৎ যেন সামান্য হাওয়ার ছোঁয়াতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিলো সে দিন।


বেঞ্চের উপরে দাড়িয়ে সামনে দাড়ানো ওদের দলের সর্দারের বুকে সজোরে এক লাথি মেরেছিলাম, কপাল ভালো মরে যায়নি, কেবল কিছক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছিলো শুধু, যাই হোক, তখন আমার এসব দেখার মত ধৈর্য ছিলোনা সর্দার কে মারছি দেখে বাকি দুটো সাগরেদ তেড়ে এলে আমি টেবলের উপর রাখা বেঁত আর ডাস্টার তুলে নিয়ে একটার গায়ে সজোরে ডাস্টার ছুড়ে মারতেই সে যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠেই টিচার্স রুমে দৌড় দিয়েছিল পেছনের দরজা দিয়ে, কিন্তু হেড স্যার আসার আগেই আমি অবশিষ্ঠ চামচাটাকে মেরে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিলাম, মারতে মারতে বেঁতটা ভেঙে গেছিল।

সে দিনের দৃশ্য ভাবলে আজও নিজেই শিউরে উঠি!

পরে এবিষয়ে অনেক ভেবেছি, এবং এর যে কারণ পেয়েছি তা হল দিনের পর দিন ওদের এই অন্যায় কে প্রস্রয় দিয়ে গেছি বাহ্যিক আমি কিন্তু অন্তরের আমি সেই দহনে ছট্ ফট্ করেছে!

" অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে!"

আসলে ঐ অন্যায় গুলো দীর্ঘ্য দিন কোনও তীব্র প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিতাম "বাইরের আমি", কিন্ত ভেতরের যে "সদা জাগ্রত আমি " তা কিন্তু কখনও মেনে নিতে পারেনি ঐ অন্যায় কে, ফলে সে বাইরের আমিকে ধিক্কার দিত এই কাপুরুষতার জন্য!

কিন্তু সেদিন বাইরের আমির সমস্ত সংযম ভেঙে গেছিল ,আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঐ ঘটনা।

*প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই বছরই আমার বাবা একদল মদ্যপ পার্টি ক্যাডার গুন্ডার হাতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় একবছর রোগ যন্ত্রনা ভোগ করে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রায় একমাস আগে অকাল মৃত্যু বরণ করেছিলেন ফলে আমার মধ্যে এই গুন্ডা ধরণের লোকেদের প্রতি ভয়ঙ্কর আক্রোশ ছিল এবং এখনও আছে! সম্ভবত সেদিন আমার মন ঐ গুন্ডা ছাত্রদের মধ্যেই সেই দিনের মাস্তানদের(যাদের জন্য আমার বাবা আজ নেই ) দেখেছিল যা আমার মনে জমে থাকা আগুন কে তীব্রভাবে খুঁচিয়ে উসকে দিয়েছিল।

এরপর, নতুন স্যার ও হেড স্যার এক সাথে এসে আমাকে জাপটে ধরে টিচার্স রুমে নিয়ে চেপে একটা চেয়ারে বসিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে অত্যান্ত শান্ত ভাবেই প্রশ্ন করেছিলেন "শুভ্র তুমি এমন কেন করলে?"

ব্যাস, আবার মাথায় যেন কেউ গরম মোম ঢেলে দিল, যেই মাথা তুলে স্যারের দিকে চাইলাম, স্যার থমকে গেলেন যেন , আমি চিৎকার করে বললাম "আপনার বাবা মরেছে? স্যার হতবাক!

আমি ছড়্ বেছড়্ বলে যাচ্ছি, আপনার চুল লাল কেন? এটা কি ফ্যাসান শো করার জায়গা?

যে মার খেয়ে বাধ্য হয়ে আপনাদের কাছে "ন্যায়" চাইতে আসে তাকেও বেঁত মারেন কেনো আপনারা?

স্যার দের সেদিন প্রচন্ড অপমান করেছিলাম, সত্যি বলতে কি, পরে যখন মাথা ঠান্ডা হল তখন আমার লজ্জার শেষ ছিলো না!

আমি শিক্ষকদের কাছে বার বার ক্ষমা চেয়েও যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না।

এরপর, লক্ষ করেছিলাম নতুন স্যার একদম সাধারণ ভাবে হেয়ার ড্রেসিং করতেন, আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম নিজের কর্মকান্ডে।

আমারই দ্বারা আক্রান্ত ঐ বন্ধু সহপাঠী দের স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলে আসতে বারন করেছিলেন, আমি পরে ওদের কাছেও ক্ষমা চেয়েছিলাম!

আজকে এত গুলো বছর পেড়িয়ে এসে, যা বুঝেছি, অনুভব করেছি, তা এই ঘটনার সারবস্তু।

যা না বললে এই ঘটনাটা অপূর্ণ থেকে যাবে তা এখন বলি,

সেদিনের আমার ঐ ব্যাবহার বা বিদ্রোহে সাময়িক লজ্জাবোধ করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঐ দিনের পরে বেশ কিছু জীবনের গতিপথ বদলে গেছিল।

আমাদের বিদ্যালয়ে এরপর থেকে কোনও ছাত্রের নামে অভিযোগ এলে শিক্ষকরা যত্নশীল ভাবে তার তদন্ত করতেন, এবং দোষিকে শাস্তি দিতেন।

প্রথমেই বলব আমার সেই বন্ধুদের কথা, সিরাজুল (নাম বদল করা হয়েছে) ওদের দলের সর্দার সেদিনের পরে আর কখনও শ্রেণী কক্ষে উপদ্রব করেনি, বরং একদিন আমাকে বলেছিলো "ভাই নির্বোধের মত অনেক ভুল কাজ করেছি, রীতিমত অত্যাচার করেছি কিন্তু বিশ্বাস কর আমি এখন তা বুঝতে পারি।"

মানিক (সাগরেদ) এখন ভালই ব্যাবসা করছে, বৌ-বাচ্চা নিয়ে বেশ সুখে আছে! পরীক্ষার শেষে ওদের বাড়ি নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম, ওর বাবা আমাদেরই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন, আমাদের স্যাররাই ওনাদেরও শিক্ষক ছিলেন।

হেড স্যার নাকি ওদের বাড়ি এসে সেদিনের ঘটনার বিবরন দিয়ে বলেছিলেন, ছেলেকে এই বেলা সামলা, নাহলে ওর ভবিষ্যত অন্ধকার! আরও বলেছিলেন, "শুভ্রপ্রকাশ স্কুলের মধ্যে একটি অত্যান্ত ভদ্র ও শান্ত ছেলে, সেই ছেলে যে অমন ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি ধরতে পারে তা কল্পনারও অতীত! তাহলে ভাব কতখানি অতিষ্ঠ হয়ে সে এমন আচরন করেছে।" ইত্যাদি।

নিমন্ত্রণ করে কাকু (মানিকের বাবা) আমার মাথায় হাতবুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, মানিক কথা দিয়েছে সে আর কখনও দুষ্টুমি করবেনা, তুমি ওকে ক্ষমা করে দিও বাবা!"

সেদিন আমি হাউ হাউ করে কেঁদে ছিলাম! কাকু আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি তো আমার বাবার মতই, আমি বুঝতে পারিনি যে এতটা হয়ে যাবে, সেদিন যে কি হল আমার, শুধু মনে হচ্ছিলো এরাই আগামী দিনে গুন্ডা মাস্তান হবে যারা আমার বাবার মত আরো কারও বাবাকে মেরে ফেলবে, আমাকে ক্ষমা করুন! মানিকের চোঁখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম! অত শক্ত ছেলের চোখেও জল, ও কাঁদছিলো!

আর বেশি লিখব না, শুধু বলব,

*" কখনও কখনও বিদ্রোহ হওয়া জরুরী, এই সমাজে সময়ের সাথে যে অন্যায়ের আস্তরন জমে তাকে পরিষ্কার করে ন্যায়কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে!"

আপনি কি সহমত এ বিষয়ে?

জানার অপেক্ষায় রইলাম।

*সম্পাদনা :- এই ঘটনাটি লিখতে গিয়ে আবেগ বসত কিছু বানান বিভ্রাট ও বাক্য বিন্যাসে ত্রুটি হয়েছিল যা উত্তর সম্পাদনার মাধ্যমে যথা সম্ভব সংশোধন করতে সচেষ্ঠ হলাম, পাঠক এই অনিচ্ছাকৃত ভুল মার্জনা করবেন এই প্রার্থনা!

ধন্যবাদান্তে, শুভ্রপ্রকাশ।

Nirob Khan
nirobkhan
300 Points

Popular Questions