সম্পর্কিত
ক্রিপ্টোকারেন্সি কী? এর বিষয়ে কি সহজ ভাবে বুঝানো যায়?
ক্রিপ্টোকারেন্সি হল এক রকমের ডিজিটাল কারেন্সি। এই কারেন্সি কোন সরকার বা রাষ্ট্র উৎপাদন বা জোগান দেয় না। এসব বিভিন্ন হার্ডওয়্যারের এর মাধ্যমে ইন্টারনেট এ যুক্ত থেকে মাইনিং করতে হয়। আর এই মাইনিং প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জটিল সব এলগোরিদম, ব্লক এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি সম্পন্ন করেই একেকটি কয়েন বানাতে হয়। ক্রিপ্টো মুদ্রা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সংকেত রীতি বিদ্যা বা ক্রিপ্টোগ্রাফি থেকে যে এমন একটি মুদ্রা আবিষ্কার করা সম্ভব, সেটা গবেষকেরা জেনেছেন আশির দশকে। কিন্তু কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন তাঁরা। ২০০৮ সালে অজানা এক গবেষক সুচারুভাবে সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে একটি গবেষণাপত্র ইন্টারনেট ফোরামে পাঠান। বিস্ময়করভাবে তাঁর সমাধান কাজে লাগে। তাঁর সমাধানের নাম ব্লক চেইন। ব্লকচেইন এলগোরিদম এর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় একটি কয়েন জেনারেট হতে প্রথম দিকে টাইম খুব কম ( মনে করুন ৫ মিনিট) লাগলেও সময়ের সাথে সাথে এর ডিফিকাল্টি বাড়তে থাকে। এতে করে এক সময় দেখা যায় একটি কয়েন জেনারেট হতে টাইম নেয় ১৫ দিনের বা ৩০ দিনেরও বেশি সময়। আর এই ডিফিকাল্টি এর সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ে কয়েন রেট। উদাহরনঃ Bitcoin, OneCoin, Litecoin, Ripple, Dogecoin ইত্যাদি।
সাধারন কারেন্সির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এই যেমন টাকা, রুপি, ইউরো, ডলার, পাউন্ড ইত্যাদি। এই সব মুদ্রা দেশ ভেদে একেক রকম হয়। এদের উৎপাদন এবং নিয়ন্ত্রন ও সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করে থাকে। এই মুদ্রার সরবরাহ ইচ্ছেমত বাড়াতে কমাতে পারে। কিন্তু প্রতিটি ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি নির্দিস্ট পরিমান কয়েন এর বেশি জেনারেট করতে পারবে না। উদাহরন স্বরূপ Onecoin সর্বোচ্চ ২.১ বিলিয়ন কয়েন জেনারেট করতে পারবে। আমাদের সাধারন মুদ্রা টাকা, ডলার এর মান যেমন এক নয় এবং মান স্থির থাকে না তেমনি সব ক্রিপ্টোকারেন্সি এর মান এক নয় এবং মান স্থির থাকে না। যতটুকু জানা যায় Bitcoin যখন মার্কেটে আসল তখন তার প্রারম্ভিক দর ছিল .১০$ এর মত।
একটি মজার একই সাথে দুঃখের ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছিঃ
মে, ২০১০ শালে লাজলো হেইঞ্জ নামের এক জন তার কাছে থাকা ১০,০০০ বিট কয়েন দিয়ে ২ টি পিঁজা কিনেছিল। বিট কয়েনের সর্ব প্রথম কোন পণ্য ক্রয় ছিল এটাই প্রথম। বিট কয়েনের ভবিষ্যৎ তিনি বুঝতে পারেন নাই। এর মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই প্রতিটি বিট কয়েন এর দাম দাড়ায় প্রায় ১২০০ USD। যদি ১ btc= 500$ ধরি তাহলে ২ টি পিঁজার মুল্য দাড়ায় 50,00,0,00 $ !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!! আফসোস সেই লাজলোর জন্যে যিনি মিলিওনিয়ার হতে পারতেন তিনি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে কিছুই হতে পারলেন না।
সম্প্রতি বিটকয়েনের অবিশ্বাস্য মূল্য বিস্ফোরণে সবার টনক নড়েছে। কেউ আর একে হেলাফেলা করতে পারছেন না। শিকাগো এক্সচেঞ্জে বিটকয়েনের ফিউচার বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ম্যারিল লিঞ্চ, ব্যাংক অব আমেরিকাসহ অনেক নামি প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা বুদ্বুদ নয়। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে অবশ্যই কারণ রয়েছে। কারণ অনেক গভীরও বটে। যতটা না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক। ইতিমধ্যেই ব্লক চেইন নতুন সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
বিটকয়েন বা ক্রিপ্টো মুদ্রার প্রয়োজন কী?
সমাজ ও জীবন যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তেমনি অর্থনৈতিক ইনস্ট্রুমেন্টেরও অগ্রগতি হচ্ছে। মুদ্রা নামের জিনিসটার অনেক বিবর্তন ঘটেছে। স্বর্ণ, রৌপ্য বা ধাতব মুদ্রা থেকে সেটা কাগুজে মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। এর নকল ঠেকাতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপর এল ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড। তা দিয়ে অর্থনৈতিক বিনিময় আরও সহজ হয়ে গেল। এগুলোকে ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ বলা যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে অভাবনীয় অগ্রগতি এনেছে ক্রিপ্টো মুদ্রা। এর কয়েকটি চরিত্র তুলে ধরা যাক।
১. এর কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান নেই। পৃথিবীজুড়ে বিপুল জনগোষ্ঠী একধরনের নিরাপদ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই মুদ্রার প্রচলন করছে। কেউ নীতিনির্ধারক নয়, সবাই সমান, নেটওয়ার্কের একটি নোড মাত্র। ক্রেতা থেকে বিক্রেতার কাছে সরাসরি, কারও মধ্যস্থতা ছাড়াই, নিরাপদ ও নিশ্চিতভাবে এই মুদ্রা চলে যাবে। এই মুদ্রাব্যবস্থার কোনো কেন্দ্রীয় রূপ নেই, এখানে সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এটাকে সরাসরি ক্রেতা-বিক্রেতার (পিয়ার-টু-পিয়ার) নেটওয়ার্ক বলে।
২. বিটকয়েনের ফলে এক মুহূর্তে যে কেউ ঘানা থেকে চীনে মুদ্রা পাঠিয়ে কোনো কিছু কিনতে পারবে। কোনো ব্যাংকের ব্যাপার নেই, কোনো মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যাপার নেই। মধ্যবর্তী কোনো সংস্থা নেই, সেটাই এই মুদ্রার ডিজাইন।
৩. এই মুদ্রা ত্বরিত এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে পারে। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগছে। কিন্তু অন্য কিছু ক্রিপ্টো মুদ্রা আরও কম সময়ে হাত বদল হতে পারে। অথচ বর্তমান মুদ্রা স্থানান্তর ব্যবস্থায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে কয়েক দিন লেগে যায়।
৪. এই মুদ্রা একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পাঠাতে নামমাত্র ফি লাগে। এটি আবার পাঠানো অর্থের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। একটি বিটকয়েন আর এক লাখ বিটকয়েন পাঠাতে একই ফি। বর্তমান মানি ট্রান্সফারে বেশ অর্থ ব্যয় হয়।
৫. ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেন জাল করা যায় না। একবার ট্রান্সফার হয়ে গেলে ওটাকে কোনোভাবে ফিরিয়ে নিতে বা পরিবর্তন করা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, হাজার হাজার মেশিনে এটা লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই লেনদেন অপরিবর্তনীয়।
৬. ক্রিপ্টো মুদ্রার কোনো মুদ্রাস্ফীতি নেই। এই মুদ্রার সংখ্যা পূর্বনির্ধারিত, তাই টাকার মতো তা আরও ছাপানো যায় না। বিভিন্ন দেশ প্রকাশ্যে বা গোপনে তাদের মুদ্রা বেশি ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, ফলে মুদ্রা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। ক্রিপ্টো মুদ্রায় এটি একেবারেই অসম্ভব। বিটকয়েনের সর্বোচ্চ সংখ্যায় ২ দশমিক ১ কোটিতে নির্ধারিত করা আছে।
বিটকয়েনের এত মূল্য কেন?
বিটকয়েনের মূল্য বাড়ার বেশ কিছু কারণ আছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—
১. মনে করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীজুড়ে সবাই ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবহার করবে। এটিকে এভাবে বোঝানো যায়, কেউ যদি ২০ বছর আগে বলত, পৃথিবীজুড়ে সবাই মুঠোফোন ব্যবহার করবে, সেটা হয়তো তখন খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। এখানেও ঠিক তেমনটি ঘটছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
২. বিটকয়েনের সংখ্যা সীমিত। তাই একটি বিটকয়েনের দাম অনেক বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, পৃথিবীর সব সম্পদ ওই সীমিত বিটকয়েন দিয়ে কিনতে হবে, তাই একেকটির দাম হবে গগনচুম্বী।
বিটকয়েন দিয়ে কি কিছু কেনা যায়?
বিটকয়েন দিয়ে বর্তমানে অনেক কিছুই কেনা যায়। যেমন ওভারস্টক ডট কম থেকে যেকোনো পণ্য বিটকয়েনের মাধ্যমে কেনা যাবে। এমন আরও অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসেবে নিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখন যেমন অর্থের বদলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে, ভবিষ্যতে তেমনি টাকা ও ক্রেডিট কার্ডের বদলে বিটকয়েন বা অন্য কোনো সাংকেতিক মুদ্রা ব্যবহৃত হবে।
hackerthon publisher