Answered 2 years ago
সত্যি সত্যি পা বাড়ালেই পৌঁছে যাওয়া যায় পর্তুগীজ গ্রামে। কলকাতা থেকে মাত্রই কয়েক ঘন্টার পথ। মীরপুর গ্রামে আজও সেদিনের সেই দুঃসাহসী নাবিক সম্প্রদায়ের বংশধরেরা বসবাস করছে। গ্রামের নামে সাহেব সাহেব গন্ধের ছিটেফোঁটাও নেই, তবু মীরপুর যেতে হলে গেঁওখালিতে এসে ভ্যান রিক্সাচালককে বলতে হবে সাহেবপাড়া বা ফিরিঙ্গিপাড়া যাব। সাদা চোখে মীরপুর বাংলার আর দশটা গ্রামের মতোই। মাটির ভিতে টালির চালের ঘর, ছোট ছোট পুকুর, খেঁজুর গাছ ঘেরা আম-কাঠালের বাগান, নীল আকাশ সবুজ মাঠে বাংলারই প্রকৃতি। ছোট্ট গ্রামটিতে দু’দুটো চার্চের অবস্থিতিতে কিছুটা অবাকই লাগে। মন্দির-মসজিদে অভ্যস্ত চোখ গির্জার রকমফেরে বিস্মিত হতেই পারে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ার জন্য রয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের নামে পরিষ্কার পর্তুগীজ উচ্চারণের লুকাস টেসরা, অ্যান্টনি রথ, ক্লারা ডিসুজার সঙ্গে রয়েছে বাংলা পর্তুগীজ মিশেলের সুবিমল ডিক্রুজ, পিনাকী রোজারিও, মাধবী পেরেরা’র মতো অনেকে। পোশাকে চলনে-বলনে এঁরা বাঙালিই হয়ে গেছেন। কথাও বলেন বাংলাতে, তবে কারও কারও কথায় আজও একটু টান।
১৪৯৮ সালে ভাস্কো-ডা-গামার কালিকট বন্দরে অবতরণ থেকে ভারতে পর্তুগীজ আগমনের সূত্রপাত। তার পর এই সেদিন গোয়ার ভারতে সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে এই উপমহাদেশ পর্তুগীজদের প্রত্যক্ষ শাসন মুক্ত হয়। মধ্যের পাঁচশো বছর তো ইতিহাস। ইংরেজদের সঙ্গে পর্তুগীজদের মূলগত পার্থক্য ছিল ধর্মপ্রচারে এদের অনাগ্রহ। ব্যাপক অত্যাচার করেছে, লুটপাট করেছে এরা ঠিকই, কিন্তু সাদা চামড়ার ভণ্ডামি এদের ছিল না। এই দেশটাকে ভালবেসে, এখানকার আচার-বিচারে শ্রদ্ধাশীল হয়ে, দেশীয় মেয়ে বিয়ে করে পর্তুগীজরা স্থানীয় জীবনস্রোতে মিশে গিয়েছিল। ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ)’ বইয়ে লিখেছেন, “… সিবাস্তিও গনজ্যালভেস তিবৌ নামে এক দুর্ধর্ষ জলদস্যু তিন বত্সর (১৬০৭-১৬১০ খ্রীঃ) সন্দীপে স্বাধীন নরপতির ন্যায় রাজত্ব করিয়াছিল … বাংলাদেশের কোন কোন জমিদার তাহার মিত্র ছিল। সৈনিক ও সেনানায়ক হিসাবে পর্তুগীজদের খুব খ্যাতি ছিল। … বাংলার বহু জমিদার এবং সময়ে সময়ে সুলতানেরাও পর্তুগীজ সেনা ও সেনানায়কদিগকে আত্মরক্ষার্থে নিযুক্ত করিতেন।” ঢাকা বা শ্রীপুরের কেদার রায়ের অধীনে সেনাপতি কার্বালোর অসীম বীরত্বের কথা অনেকেরই জানা। এইরকম একদল দুঃসাহসিক পর্তুগীজ সৈনিককে মেদিনীপুরের মহিষাদলের রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায় (মতান্তরে তাঁর স্ত্রী জানকী দেবী) খ্রীষ্টীয় আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্গীদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য এই গ্রামে বসতি করান। প্রসঙ্গত, মীরপুর মহিষাদলের চার মাইল পূর্বে অবস্থিত। ঠিক কোথা থেকে এদের আনা হয়েছিল সে ব্যাপারে দ্বিমত আছে। তবে সপরিবারে না আসার দরুন ক্রমশ স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে এরা যে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠেছিল সেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
এইভাবেই, নৃতত্ত্বগতভাবে, সংস্কৃতিতে ও ভাষায় গড়পড়তা বাঙালির সঙ্গে এদের তেমন কোনও পার্থক্য নেই। তবে দু’একজনকে এখনও দেখা যায় যাদের রঙ খুব ফর্সা, চুল কটা, চোখ নীল। যেমন লিলি লেবোকে দেখেছিলাম। অনেকগুলো বাচ্চার ভিড়েও লিলিকে ঠিক আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল, ওর দৈহিক বৈশিষ্ট্যে। সাগরপারের পশ্চিমী ছাপ এখনও ওর মধ্যে স্পষ্ট না হলেও একেবারে আবছা নয়। এখানকার বিধবারা সরু পাড়ের সাদা শাড়ি পরেন অথচ দিব্যি মাছ, মাংস, পেঁয়াজ খান।
গ্রামের মাঝখানে আছে সুন্দর সাজানো ক্যাথলিক চার্চ। সামনে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি বেদির ওপরে বসানো। চারিদিকে বাগান। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ। ক্যাথলিকেরা কলকাতার সেন্ট পলস চার্চ এবং প্রোটেস্ট্যান্টরা বৈঠকখানা চার্চকে তাঁদের প্রধান গির্জা বলে মানেন। গাঁয়ের ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টের অনুপাত ৫ : ৩। সাধারণত এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয় না। যদিও ক্যাথলিকরাই এ ব্যাপারে বেশি গোঁড়া। তবে ইদানিং ছেলেমেয়েরা দেখেশুনে বিয়ে করছে, আর স্বভাবতই প্রেমের জোয়ারে এসব বাধানিষেধ খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে।
গ্রামবাসীরা পেশায় মূলত কৃষিজীবী। প্রায় সবাই জমিজমার মালিক। কেউ কেউ চাকরিও করেন। দক্ষ নাবিক ছিল এই পর্তুগীজেরা। জলজীবন এদের রক্তে। নেশার মতো সেই আকর্ষণ। আর সে কারণেই এখানকার কেউ কেউ জাহাজে চাকরি করেন আজও। কেউ কেউ আবার শিক্ষকতাও করেন। তবে ইদানিং বেকার সমস্যা এখানেও শিকড় গেড়েছে। বেড়েছে রাজনৈতিক সচেতনতা।
গ্রামের ছোট্ট কবরখানা ঢোকার মুখে অ্যান্টনি রথার তৈরি ফলক। এখন অবশ্য কবরের ওপরে আর ফলক করতে দেওয়া হয় না। জমির স্বল্পতাই এর কারণ। এখানকার দুটি জীর্ণ কবর চোখ টানে। একটি ব্রজনাথ পালের, অপরটি ঠিক তাঁর পাশে ডক্টর মিসেস কাদম্বরী আচার্যের। মিসেস আচার্যের মর্মর স্মৃতিফলকে বাংলা ও ইংরেজি লিপিতে লেখা আছে- জন্ম ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল, মৃত্যু ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ মে। ‘She hath done what she could = MARK XIV’। কাদম্বরী আচার্য ছিলেন মহিষাদল রাজপরিবারের অন্দরমহলের লেডি ডাক্তার। তাঁর মৃত্যুর পর কাছাকাছি সমাধিস্থ করা যায় এমন কোনও কবরস্থান খুঁজে না পেয়ে মৃতদেহটিকে হাতির পিঠে করে এখানে এনে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কাদম্বরী আচার্যের আর একটি পরিচয়, তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত রাজ্যপাল ডাঃ হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের শাশুড়ি।
মীরপুর প্রকৃত অর্থেই একটি সাম্প্রদায়িক মিলনক্ষেত্র। সেদিনকার পর্তুগীজরা আজ পাশাপাশি পড়শি হিন্দু পরিবারের আনন্দে বেদনায় জড়িয়ে গেছে। হিন্দুদের পূজাপার্বণ, ব্রত উদযাপন, বিবাহ অনুষ্ঠানে তারা মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করে। এখানকার যুবকেরা বয়সের ধর্মেই অন্য ধর্মের যুবকদের সঙ্গে মিশে গেছে। সবুজ সংঘ এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে। পিনাকী রোজারিও, শ্রীশ মণ্ডল, শেখ শামিমরা একই সঙ্গে সরস্বতী পুজা, গুড ফ্রাইডে কিংবা ঈদের উত্সব পালন করে। দুর্গা পূজার সময় নাটক করে সম্মিলিতভাবে।
এই অন্যরকম গ্রামে এসে এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতার স্পর্শ পেতে পারেন যে কেউ। দিনে দিনেও বেড়িয়ে নেওয়া যায়। আবার গাদিয়ারা ভ্রমণার্থীরা এক বেলায় সাঙ্গ করে নিতে পারেন এই বেড়ানো। এখান থেকে খুব কাছেই মহিষাদল রাজবাড়ি। হাতে সময় থাকলে সেখানেও চলে যান।
runalaila publisher