"ককখগগখকক ঘঙচঘঙচ " কি সিনেটের সার্থক অন্ত্যমিল হতে পারে?

1 Answers   10.4 K

Answered 2 years ago

প্রথমতঃ একটা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দিয়ে রাখি, আমি ব্যকরণ-বিশেষজ্ঞ নই, ছান্দসিক ও নই, এমনকি কবিও নই। আমি কেবল একজন পাঠক। সে হিসেবে আমার পঠিত সনেট, ও তৎসম্পৃক্ত নিবন্ধের থেকে উত্তর লিখব। কাজেই এতে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। দ্বিতীয়তঃ যাঁরা এতটুকু পড়েই "না জানলে লিখছিস কেন!" জাতীয় সম্মানজনক মন্তব্য করার জন্য উসখুস করছেন, তাঁরা স্বচ্ছন্দে গিয়ে নিজের সাথে সঙ্গম করতে পারেন। আমি, রেস্পেক্টফুলি, আপনার থোড়াই পরোয়া করি! তবে যদি শ্রেয় উত্তর আপনার জানা থাকে, বিলক্ষণ তা লিখুন, সেক্ষেত্রে আমি আপনার লেখা শিরোধার্য করে এই উত্তর ডিলিট করে দেব। বেশ, তাহলে ""ককখগগখকক ঘঙচঘঙচ " কি সিনেটের সার্থক অন্ত্যমিল হতে পারে?" প্রশ্নের উত্তর কি? 'সিনেট' শব্দকে 'সনেট' এর মুদ্রণপ্রমাদ ধরে নিয়ে, আমার মতে, হ্যাঁ। সম্ভবতঃ হতে পারে। যদিচ, অলরেডি হয়ে গেছে কি না তা আমি জানি না। আমার জ্ঞাতানুসারে বিলিতি সনেটের ধ্রুপদী ছন্দ প্রধানতঃ চতুর্বিধ। যথাক্রমে পেত্রার্ক, শেক্ষপীর, স্পেন্সার ও মিলতন এই চার মহর্ষির নামানুসারে। ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি, সনেটের মিলপ্রকল্প (rhyme scheme)কে ছয়, আট অথবা তিনভাগে ভাগ করার চলও রয়েছে। আপনি যখন সনেটের ব্যকরণ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, আপনি বিলক্ষণ এই বহুবিধ মিলপ্রকল্প সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সম্ভবতঃ আমা হেন এ্যামেচারের থেকে আপনার জ্ঞান বেশী বই কম নয়, কাজেই সে বিস্তারে যাচ্ছি না। নিতান্ত ঝালিয়ে নিতে চাইলে বরং গুগলিয়ে নিন। সে যাই হোক, এই যাবতীয় সনেটের একটি অষ্টক (ইংরিজিতে octave)ও একটি ষটক(ইংরিজিতে sestet বা sextet) থাকা দস্তুর। আর দুয়ের মাঝে থাকবে একটা ভোল্টা বা মোড়। বাংলাতে এজাতীয় সনেট লিখেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর লেখা এখানে কপি করা অনাবশ্যক। বঙ্গভাষা বা কপোতাক্ষ নদ অন্তত ইশকুলের বইতে পড়েন নি এমন বাঙালি বিরল! তবে এসব কঠিন নিয়মের নিগড় ছাড়াও বিস্তর সনেট লেখা হয়েছে। এবং বর্তমানে সনেটের জন্য অন্ত্যমিল থাকা আর বাধ্যতামূলক নয়। এইখানে ফেরএকটা ডিঃ দিতে হয়। এমন ছান্দসিকও রয়েছেন, যাঁরা বলবেন অন্ত্যমিল বাদ দিলে সনেট হয় না। তবে পাবলো নেরুদা নামে জনৈক দক্ষিণ আমেরিকান কবি এতে প্রভূত আপত্তি জানাবেন। একহাতা নেরুদা দিয়ে রাখলাম, আপনিই চেখে দেখুন। Soneto XVII by Pablo Neruda Sonnet XVII I don’t love you as if you were the salt-rose, topaz or arrow of carnations that propagate fire: I love you as certain dark things are loved, secretly, between the shadow and the … https://poemfortoday.wordpress.com/2010/04/05/soneto-xvii-by-pablo-neruda/ আর রয়েছেন আল মাহমুদ - মিথ্যায় প্রসন্ন হলে, বলতাম, দেখেছি আমিও সে অক্ষয় উজ্জ্বলতা, অলৌকিক স্পর্শের অতীত; অইতো মহান তিনি, নিরুপম, পরম সুন্দর আমার সম্মুখে অই অবিশ্বাস্য তৃষ্ণাতাপহীন বর্ণহীন নির্বিরোধ, বলতাম পেলাম প্রথম অসাধ্য যা চিরকাল অগোচর অসহ্য গোপন আমার অঙ্গনে একি আলোময় অকথ্য পুলক- মিথ্যায় অভ্যস্ত হলে এই মত বলা কি যেত না? বুঝিবা অদৃশ্য ছাড়া কিছু নেই প্রত্যক্ষ গোচরে অভয়ের মতো আমি মুখচ্ছবি দেখিনি অন্তত কৃপাহীন দীর্ঘশ্বাস আদিগন্ত শূন্যতা ব্যাদান করে আছে চিরকাল, আয়ুষ্কাল গ্রাস করে আছে একটি অমোঘ প্রশ্ন, যেন কার অব্যর্থ শায়ক ছুঁড়েছে রক্তের দিকে লক্ষ্য মাত্র আমার শরীর। - (রক্তের দিকে, আল মাহমুদ ) ভালো কথা, এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাংলা সনেটের আলোচনাতে যেতে চাইলে আল-মাহমুদ (যাঁকে রাজনৈতিক কারণে লোকে আদর করে 'বাল মাহমুদ' বলে ডাকতেন) অবশ্যপাঠ্য। ওনার অনাবশ্যক হিন্দু-ইহুদীবিদ্বেষ, ঘোর ধর্মীয় গোঁড়ামি, অথবা বখতিয়ারের ঘোড়া জাতীয় অপাঠ্য রচনা নটউইথস্ট্যান্ডিং, ভদ্রলোকের কিছু লেখা রয়েছে যা এড়িয়ে বাংলা সনেটের চর্চা করা অসম্ভব। ইচ্ছুক জনে সোনালি কাবিন পড়ুন। (দোষে-গুণে মেশানো আল মাহমুদকে নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা জমে রয়েছে, হয়তো পরে কখনো জমা দেব। কিন্তু তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক)। বেশ, অন্ত্যমিল না থাক, আট-ছয় আর তার মাঝে ভোল্টা চাই? না কি গুনে গেঁথে চোদ্দ লাইন থাকলেই হল? ফের বলি, দুরকমের মতই রয়েছে। যেদিকে খুশী স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারেন। তবে এযাত্রায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে সাথে পাবেন। ওনার সনেটে এই অষ্টক-ভোল্টা-শতক ভেদ হরহামেশাই অন্তর্হিত। রবীন্দ্রনাথ বরং চোদ্দ লাইনের এমন কবিতাও লিখে গেছেন, যাকে সনেট বললে রবীন্দ্ররচনাবলী অশুদ্ধ হয় কিনা তাই নিয়ে আজও কাব্যরসবিদগ্ধ রবীন্দ্র-গবেষকের দল লাঠালাঠি করে চলেন। পরলোক থেকে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবজ চ্যাংড়ামিতে(হ্যাঁ সার, ঋষি-মহর্ষি-মনিষী যাই বলুন, ভদ্রলোক জীবৎকালে সাঙ্ঘাতিক চ্যাংড়া ছিলেন! বিশ্বাস না হয় ওনার গদ্য পড়ুন।) অট্টহাসি হাসছেন কি না জানা যায় না! ছত্রে ছত্রে নানা মুনির নানা মত দেখতে পাচ্ছেন তো? এতে ঘাবড়াবেন না। এ তো আর পাটিগণিত কি জীবনবিজ্ঞান নয়!! নানা মত থাকবেই। আপনি যে মতেই যান না কেন, পাইকারি কিল মারার মতো সমালোচকের অভাব ঘটবে না। কাজেই চালান না আপনার নিজস্ব ছন্দ, কে ঠ্যাকাচ্ছে? আফটার অল, আদি অর্থ অনুসারে সনেট মানে সম্ভবত ছোট্ট আওয়াজ বা ছোট্ট গান!! এবারে একটু দেখব আপনার কথিত মিল প্রকল্পের উদাহরণ পাওয়া যায় না কি। আগেই বলেছি, আমার জানামতে এরকম উদাহরণ নেই। তবে নতমস্তকে এও স্বীকার করে রাখি, "আমার যা জানা নেই তেমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না" এরকম আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার পক্ষে আমার বয়স খানিকটা বেশীই। ফলতঃ, উদাহরণ থাকতেই পারে! অষ্টকে যে ককখগগখকক মিল প্রকল্পের কথা আপনি বলেছেন, বাংলা কবিতায় তার উদাহরণ নেই, বা থাকলেও বিরল। কাছাকাছি (কখক কখখ কখ) পাচ্ছি স্বয়ং রবিঠাকুরের লেখা সন্ধ্যার বিদায় - সন্ধ্যা যায়,​​ সন্ধ্যা ফিরে চায়, ​​ শিথিল কবরী পড়ে খুলে-- (ক) যেতে যেতে কনক-আঁচল ​​ বেধে যায় বকুলকাননে, (খ) চরণের পরশরাঙিমা ​​ রেখে যায় যমুনার কূলে-- (ক) নীরবে-বিদায়-চাওয়া চোখে, ​​ গ্রন্থি-বাঁধা রক্তিম দুকূলে (ক) আঁধারের ম্লানবধূ যায় ​​ বিষাদের বাসরশয়নে। (খ) সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে ​​ চেয়ে থাকে আকুল নয়নে। (খ) যমুনা কাঁদিতে চাহে বুঝি, ​​ কেন রে কাঁদে না কণ্ঠ তুলে-- (ক) বিস্ফারিত হৃদয় বহিয়া ​​ চলে যায় আপনার মনে। (খ) রবীন্দ্রিনাথ অবশ্য এর পরের অংশে গকগক ঘঘ ব্যবহার করেছেন। তবে আপনার ষটকের ঘঙচ ঘঙচ মিলের উদাহরণ আছে - অতএব চাকরি বিনে কস্মিনকালে ফুটপাথ (ঘ) হতো না চষতে আর ভাগ্যহীন কুকুরের মতো (ঙ) একটি হাড়ের খোঁজে ক্রমাগৎ গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে (চ) হতাম না ক্লান্ত শুধু। আপাতত এই শীর্ণ হাত (ঘ) করি সমর্পণ দুস্থ জ্যোতিষীর কাছে, ভাগ্যহত - (ঙ) রূপালী পর্দার লীলা অবিরত থাকে চোখ জুড়ে। (চ) - শামসুর রহমান, একজন বেকারের উক্তি যদিও এই সনেটের অষ্টক আপনার উল্লিখিত ককখগগখ কক ছন্দে নয়, বরং সরল কখখক গঘঘগ। কাজেই দেখা যাচ্ছে আপনার ককখগগখকক-ঘঙচ ঘঙচ মিলপ্রকল্পের উদাহরণ অন্তত আমার জানা নেই। কিন্তু আলাদা আলাদা করে প্রায় দুটি প্রকল্পই বিদ্যমান। কাজেই মাভৈঃ ! লিখে ফেলুন। আফটার অল সনেটই লিখতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে?
Ajit Kumar
ajitkumar
262 Points

Popular Questions