Answered 2 years ago
অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসছে। অ্যামেরিকার অর্থনীতিকে নিঃশেষ করছে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ আর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সামরিক সম্প্রসারণ। বাড়তে থাকা ঋণ, ঘাটতি, ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইযেশান এবং বৈশ্বিক নানা বাণিজ্যচুক্তির ভারে ভেঙে পড়ছে অ্যামেরিকার অর্থনীতি। অ্যামেরিকার গণতন্ত্রকে জিম্মি ও ধ্বংস করে ফেলেছে। ট্যাক্স মওকুফ, ডি-রেগুলেইশান এবং ভয়ংকর মাত্রার জোচ্চুরির পর সব ধরনের জবাবদিহি থেকে অব্যাহতির আবদার করা, আর সরকারি বেইল-আউটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার লুট করা বড় বড় কর্পোরেশানগুলো। ইউরোপ, ল্যাটিন অ্যামেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোকে দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য যে ন্যূনতম সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়া দরকার, জাতি হিসেবে অনেক আগেই সেটা হারিয়েছে অ্যামেরিকা। এ সবকিছুর সাথে যোগ করুন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘনিয়ে আসা বিপর্যয় পেয়ে যাবেন অবশ্যম্ভাবী এক ডিসটোপিয়ার (Dystopia) রেসিপি। এ পতনের তদারকি করছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে থাকা, মূর্খ, ভণ্ড, চোর, সুবিধাবাদী আর যুদ্ধবাজ জেনারেলদের এক বিচিত্র দল। আর স্বচ্ছতার খাতিরে, এখনই বলে দিই, রিপাবলিকান আর ডেমোক্রেট, দুদলের কথাই আমি বলছি।
আরও কিছুদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাবে অ্যামেরিকান সাম্রাজ্য। দিন দিন প্রভাব কমতে থাকবে। একপর্যায়ে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্ত নেবে রিযার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলারের ব্যবহার বন্ধ করার। আর ঠিক তখনই এমন এক মারাত্মক, অবশ করে দেয়া। অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হবে অ্যামেরিকা, যা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বাধ্য করবে নিজ সমরযন্ত্রের আকার কমিয়ে আনতে। আকস্মিক ও ব্যাপক গণবিদ্রোহ ছাড়া ক্রমেই। নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকা এই সাম্রাজ্যের পতন, এ ধীর কিন্তু নিশ্চিতগতির মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব। আর এমন কোনো বিদ্রোহের সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। যার অর্থ হলো, সর্বোচ্চ এক থেকে দু-দশকের মধ্যে আমাদের চেনা অ্যামেরিকার আর অস্তিত্ব থাকবে না।
অ্যামেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগ (Department of Defense) At Our Own Peril: DoD Risk Assessment in a Post-Primacy World' নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী অ্যামেরিকার সামরিক বাহিনীর ‘(বিভিন্ন) রাষ্ট্রীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আগের মতো অজেয়, অনাক্রমণীয় অবস্থান আর নেই' এবং ‘অ্যামেরিকান সামরিক বাহিনী এখন আর আগের মতো নিজ শক্তির কেন্দ্রের বাইরে, সুসংহত এবং টেকসই আঞ্চলিক সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে সমর্থ না’।
In the Shadows of the American Century: The Rise and Decline of US Global Power' এর লেখক ঐতিহাসিক অ্যালফ্রেড ডাবিউ, ম্যাকয়ের ধারণা অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যের পতন আসবে 2030 এর মধ্যে।
ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যগুলো আত্মহননের একগুঁয়ে পথ বেছে নেয়। ঔদ্ধত্য তাদের অন্ধ করে রাখে, তারা স্বীকার করতে পারে না নিজেদের কমতে থাকা ক্ষমতার বাস্তবতা। বাস্তবতাকে মুছে দিয়ে তারা এমন এক কল্পরাজ্যে আশ্রয় নেয় যেখানে প্রবেশাধিকার থাকে না কঠিন ও অপ্রিয় সত্যগুলোর। গণতন্ত্র, জোটবদ্ধতা এবং রাজনীতিকে তারা প্রতিস্থাপন করে একপাক্ষিক হুমকি আর যুদ্ধের হাতুড়ি দিয়ে।
সামষ্টিক এ আত্মপ্রতারণার কারণেই অ্যামেরিকা ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক স্ট্র্যাটিজিক ভুল করেছিল—ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণ। এ ভুলই বাজিয়ে দেয় অতিকায় অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যের বিদায়ঘণ্টা। বুশ প্রশাসনের সময়কার এ যুদ্ধের ব্যাকুল স্থপতিদের এবং মিডিয়া ও অ্যাকাডেমিয়ায় তাদের মূর্খ স্তাবক তোতাপাখিদের এ দেশদুটোর ব্যাপারে বাস্তব ধারণা ছিল খুব কম। এ ধরনের যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা ছিল শিশুসুলভ, এবং এ আক্রমণের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া মোকাবেলার কোনো রকমের প্রস্তুতি তাদের ছিল না। তারা দাবি করেছিল, সম্ভবত বিশ্বাসও করেছিল, সাদ্দাম হুসেইনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, যদিও এ দাবির পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ তাদের কাছে ছিল না। তারা বলেছিল, বাগদাদে গণতন্ত্র স্থাপিত হবে, তারপর তা ছড়িয়ে পড়বে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। অ্যামেরিকান জনগণকে তারা আশ্বস্ত করেছিল—ইরাকি ও আফগানরা অ্যামেরিকান সেনাদের • ত্রাণকর্তা হিসেবে বরণ করে নেবে হাসিমুখে, কৃতজ্ঞচিত্তে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইরাকের তেলের টাকা দিয়েই ইরাক পনর্গঠন করা সম্ভব হবে।
জোরগলায় দাবি করেছিল, দ্রুত ও আগ্রাসী সামরিক আঘাত—শক অ্যান্ড অ' (shock & awe)—মধ্যপ্রাচ্যে অ্যামেরিকান কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে।
বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
যেবিগ্লিউ ব্লেনিস্কির ভাষায়, 'ইরাকের বিপক্ষে স্বেচ্ছায় শুরু করা এই একপাক্ষিক যুদ্ধ অ্যামেরিকান বৈদেশিক নীতির অন্যায্যতার ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত দ্রুত, অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিল।'
সাম্রাজ্যের অন্তিম পর্যায়ে ঘটা এসব সামরিক কেলেঙ্কারিকে ঐতিহাসিকরা বলেন। ‘মাইক্রো-মিলিটারিযম' (micro-militarism)। এথেন্সবাসী মাইক্রো-মিলিটারিয়ামে লিপ্ত হয়েছিল পেলোপোনেইশান (৪৩১-৪০৪ খ্রিষ্টপূর্ব) যুদ্ধের সময় সিসিলি আক্রমণের মাধ্যমে। এর ফলে তারা হারিয়েছিল ২০০ জাহাজ ও হাজার হাজার সেনা। এ ঘটনা ছিল স্ফুলিঙ্গের মতো, যা পুরো সাম্রাজ্যজুড়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহের দাবানল। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ প্রণালির জাতীয়করণকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বের জের ধরে মিসর আক্রমণ করে একই ধরনের ভুল করেছিল ব্রিটেন। আক্রমণের অল্প কিছুদিন পরই অপমানিত ব্রিটেন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। এ ঘটনার ফলে আরবজুড়ে পাকাপোক্ত হয়েছিল জামাল আব্দুন নাসেররের মতো জাতীয়তাবাদী নেতাদের অবস্থান; যে ক'টি অবশিষ্ট উপনিবেশের ওপর তখনো ব্রিটেনের কর্তৃত্ব টিকে ছিল এ ঘটনার পর তারা হারায় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণও। এথেন্স বা ব্রিটেন, কেউই এ ভুলগুলোর পর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
ম্যাকয়ের মতে,
‘সামরিক শক্তি প্রয়োগ, দখলদারিত্ব ও দূরবর্তী উপনিবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উদীয়মান সাম্রাজ্যগুলো বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি ও যৌক্তিক চিন্তার পরিচয় দেয়। অন্যদিকে ম্লান হয়ে আসা পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যগুলোর ঝোঁক থাকে শক্তিপ্রদর্শনের হঠকারী পদক্ষেপ আর কাল্পনিক কোনো সামরিক মহাকৌশলের মাধ্যমে এক ধাক্কায় হারানো সম্মান ও শক্তি ফিরে পাবার আকাশকুসুম স্বপ্নের দিকে। অধিকাংশ সময় অযৌক্তিক এসব মাইক্রো-মিলিটারি অভিযান আর যুদ্ধের খরচ জোগাতে গিয়ে ক্রমেই হতে থাকে সাম্রাজ্যের সম্পদ। অথবা তারা লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়, যা আরও ত্বরান্বিত করে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া পতনের প্রক্রিয়াকে।
অন্যান্য জাতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিই যথেষ্ট না। সাম্রাজ্যগুলোর আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়—এক ধরনের মিস্টিক (Mystique) । এমন কিছু যা আড়াল করে রাখবে সাম্রাজ্যবাদী লুটপাট, শোষণ ও নিপীড়নকে। এমন কোনো মুখোশ যা উপনিবেশের বোকা নেটিভ অভিজাতদের প্রলুব্ধ করবে সাম্রাজ্যবাদের জন্য কাজ করতে, অথবা কমসেকম তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখবে। আর যেসব জনগণ ও সেনাদের পয়সা ও রক্ত দিয়ে সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে—এই মিস্টিক তাদের সামনে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে উপস্থাপন করবে সভ্যতা; এমনকি মাহাত্ম্যের প্রলেপ দিয়ে।
কেন্দ্রের আদলে উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের আপাতপ্রতিষ্ঠা, পোলো, ক্রিকেট আর ঘোড়দৌড়ের মতো বিভিন্ন ব্রিটিশ খেলার আমদানি, জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকের রাজপ্রতিনিধি আর মহাসাড়ম্বরে রাজবংশীয়দের প্রদর্শনী—এ সবকিছু ছিল ওই মিস্টিক, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ‘অজেয় নেভি ও সামরিক বাহিনীর’ পরিপূরক হিসেবে কাজ করত। ১৮১৫ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত ইংল্যান্ড নিজের সাম্রাজ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর সে বাধ্য হয় বিশ্বমঞ্চ থেকে নিয়মিত পশ্চাদপসরণে।
গণতন্ত্র, মুক্তি আর সাম্য নিয়ে অ্যামেরিকার গালভরা বুলির পাশাপাশি বাস্কেটবল, বেইসবল ও হলিউড, অ্যামেরিকার সামরিক বাহিনীকে পূজনীয়, অজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রায় ঐশ্বরিক এক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন—এ সবকিছুই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মন্ত্রমুগ্ধ কিংবা আতঙ্কিত করে রেখেছিল বিশ্বকে। কিন্তু পর্দার আড়ালে, অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটেছিল, মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থান, সাজানো নির্বাচন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, প্রপাগ্যান্ডা ক্যাম্পেইন, ঘুষ, ব্ল্যাকমেইল, হুমকি ও নির্যাতনের মতো সিআইএ-এর নানা নোংরা কৌশলের মাধ্যমে।
কিন্তু এসব কূটকৌশল এখন আর কাজ করছে না।
অ্যামেরিকা তারমিস্টিক হারিয়েছে। এ অপূরণীয় ক্ষতি তাকে ‘প্রায় অক্ষমে পরিণত করেছে। ফলে কঠিন হয়ে গেছে সাম্রাজ্যের দেখাশোনার জন্য দালাল খুঁজে পাওয়া, যেমনটা আমরা ইরাক ও আফগানিস্তানে দেখেছি, দেখছি। আবু থুরাইবে আরব বন্দীদের ওপর চালানো শারীরিক ও যৌন-নির্যাতনের ছবিগুলো মুসলিমবিশ্বে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং আল-কায়েদা ও আইএস-এর জন্য জোগান দিয়েছে অসংখ্য নতুন সদস্য। ওসামা বিন লাদেন ও মার্কিন নাগরিক আনওয়ার আল আওলাকিসহ বিভিন্ন জিহাদি নেতাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুপ্তহত্যা অ্যামেরিকার প্রচারিত আইনের শাসনের (Habeas Corpus) পুরো ধারণাকেই উপহাসে পরিণত করেছে। হাস্যাস্পদ করে তুলেছে অ্যামেরিকার আইনের শাসনের বুলিকে। লক্ষ লক্ষ মৃতদেহ, অ্যামেরিকার ব্যর্থ সামরিক আগ্রাসনের পরিণতি থেকে পালাতে বেপরোয়া লক্ষ লক্ষ আরব রিফিউজি এবং ডোন হামলার প্রায় নিরবচ্ছিন্ন হুমকি প্রকাশ করে দিয়েছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে অ্যামেরিকার আসল চেহারা। ব্যাপক নৃশংসতা, নির্বিচার সহিংসতা, মিথ্যা এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর মতো হিসেবের গরমিলের প্রতি যে আসক্তি ভিয়েতনামে অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে তার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
দেশের বাইরে চালানো এ নৃশংসতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশের ভেতরের সহিংসতা। সামরিকায়িত এক পুলিশ বাহিনী নিয়মিত গুলি করে হত্যা করছে নিরস্ত্র গরিব এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের। বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র ৫% হবার পরও অ্যামেরিকার কারাগারগুলোতে আজ আবদ্ধ পুরো পৃথিবীর মোট বন্দীদের ২৫%। অ্যামেরিকার অনেক শহর ধ্বংস হয়ে গেছে। গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিরাজ করছে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। অবনতি হচ্ছে মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাইভেটাইয করা হচ্ছে। অপিঅয়েড।০১। আসক্তি, আত্মহত্যা, বন্দুকধারীদের চালানো গণহত্যা, ডিপ্রেশান এবং বীভৎস স্থূলতা আজ প্লেগের মতো জেঁকে বসেছে প্রগাঢ় হতাশার অন্ধকূপে আটকে যাওয়া এক জনগোষ্ঠীর ওপর।
অ্যামেরিকার শাসনব্যবস্থার ওপর ওয়াল স্ট্রিটের নীরব কর্পোরেট অভ্যুত্থান এবং রাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি অংশকে ভোগানো দারিদ্র্য, ‘অ্যামেরিকান ড্রিমের ব্যাপারে খোদ অ্যামেরিকানদের মোহমুক্তি ঘটিয়েছে। জন্ম দিয়েছে গভীরে প্রোথিত ক্ষোভ। এ প্রতিক্রিয়া একদিকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছে ট্রাম্পকে, অন্যদিকে ভেঙে দিয়েছে ‘অ্যামেরিকার একটি কার্যকরী গণতন্ত্র’ হবার মিথ্যে ধারণা। অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্টের টুইট এবং বক্তব্যগুলো ঘৃণা, বর্ণবাদ, গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ, দুর্বল ও অসহায়দের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ভরা। এই প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের অধিবেশনে সরাসরি হুমকি দিয়েছে একটি রাষ্ট্রকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার এবং একটি জাতির ওপর গণহত্যা চালানোর।
অ্যামেরিকা এখন বিশ্বজুড়ে উপহাস ও ঘৃণার পাত্র।
অন্ধকার ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিচ্ছে একের পর এক ডিস্টোপিয়ান সিনেমা। হলিউড আজ আর অ্যামেরিকার মাহাত্ম্যের কথা বলে না, অ্যামেরিকার বিশেষত্বের কথা বলে না, আওড়ায় না মানবজাতির উন্নতির মুখস্থ, মিথ্যে বুলি; বরং ছবি আঁকে এক অন্ধকার, হতাশাময় ভবিষ্যতের।
অ্যালফ্রেড ম্যাকয়ের ভাষায়,
‘শ্রেষ্ঠ বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে অ্যামেরিকার মৃত্যু আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক দ্রুত হতে পারে। যদিও সাম্রাজ্যগুলোর অসীম শক্তিধর বা অজেয় হবার একটা ধারণা প্রচলিত থাকে, কিন্তু আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যগুলো হয় বিস্ময়কর রকমের ভঙ্গুর। একটা সাধারণ জাতিরাষ্ট্রের সমান সহজাত শক্তিও তাদের থাকে না। সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটতে পারে বিভিন্ন বিচিত্র কারণে। অতীতের সাম্রাজ্যগুলোর ইতিহাসের দিকে একনজর তাকানোই এ সত্য মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে সাধারণত প্রধান অথবা প্রাথমিক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে রাজস্ব ও অর্থনৈতিক চাপ।
প্রায় দু-শতাব্দী ধরে অধিকাংশ স্থিতিশীল রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল স্বদেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি অর্জন এবং তা বজায় রাখা। বৈদেশিক বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ছিল অপশনাল। এর পেছনে বাজেটের ৫% এর বেশি ব্যয় করা হতো না। কিন্তু একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে প্রায় প্রাকৃতিকভাবে যে অর্থায়নের উদ্ভব ঘটে, সাম্রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে সেটা ঘটে না। তাই যেকোনো মূল্যে লুটপাট অথবা মুনাফার জন্য বুভুক্ষু শিকারির মতো আচরণ করে সাম্রাজ্যগুলো। অ্যাটল্যানন্টিক দাস ব্যবসা, কঙ্গোতে বেলজিয়ামের রাবার লালসা, ব্রিটেনের ভারতীয় আফিম বাণিজ্য, তৃতীয় রাইখের হাতে ইউরোপের ধর্ষণ অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা পূর্ব ইউরোপের শোষণ সাম্রাজ্যবাদ এমন আচরণের জন্য কুখ্যাত।
কিন্তু যখন রাজস্বপ্রবাহ শুকিয়ে আসে, কিংবা থেমে যায়, ম্যাকয়ের মতে—‘অতিকায় সাম্রাজ্যগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যগুলোর ক্ষমতার বলয় এতটাই দুর্বল যে, আসল বিপদ এলে তাদের পতন ঘটে অভাবনীয় দ্রুততার সাথে।
পর্তুগালের সময় লেগেছিল মাত্র বছর, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেগেছিল দু বছর, ফ্রান্সের আট বছর, অটোমানদের এগারো বছর, ‘গ্রেট ব্রিটেনের’ সতেরো বছর এবং খুব সম্ভবত অ্যামেরিকার জন্য সময়টা হলো ২০০৩ এর ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে ২৭ বছর।
ইতিহাস থেকে মোটমাট ৬৯টি সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের কথা জানতে পাওয়া যায়। কোনোটিই পতনের সময় যোগ্য নেতৃত্ব পায়নি। বরং পতনের কালে ক্ষমতা গেছে। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা অথবা নিরোর মতো বিকৃত পশুদের কাছে। আমরা হয়তো "এখন অ্যামেরিকায় বিকৃত, অসুস্থ, গলাবাজ নেতাদের কাছে শাসনকর্তৃত্ব যাবার এ প্রক্রিয়ারই বাস্তবায়ন দেখছি।
ম্যাকয়ের মতে,
‘অধিকাংশ অ্যামেরিকান ২০২০ এর দশককে মনে রাখবে—সেই একই বেতন দিয়ে হতাশাজনক, মনোবল ভেঙে দেয়া মূল্যস্ফীতির বাজারের মুখোমুখি হওয়া, আর ম্লান হতে থাকা আন্তর্জাতিক প্রভাবের জন্যে।
বৈশ্বিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলারকে যখন বাদ দেয়া হবে, তখন আর ডলার ছাপিয়ে ঋণ আর বাজেট ঘাটতি মেটাতে পারবে না অ্যামেরিকা। খুব দ্রুত, খুব তীব্রভাবে অবমূল্যায়ন ঘটবে অ্যামেরিকান ট্রেজারি বন্ডের। বেড়ে যাবে আমদানির খরচ। বিস্ফোরণ ঘটবে বেকারত্বের। অগুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু নিয়ে সংঘর্ষ দেখা দেবে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে। ফলে উত্থান ঘটবে বিপজ্জনক কট্টর জাতীয়তাবাদের (hyper nationalism)—যা জন্ম দিতে পারে অ্যামেরিকান ফ্যাসিজমের।
পতনের যুগেও সন্দেহবাতিক, বিচ্ছিন্ন, অপমানিত, নিন্দিত অভিজাত শ্রেণি প্রতিটি পাঁকে খুঁজে পাবে শত্রু। পাইকারি নজরদারি, নাগরিক স্বাধীনতার ধ্বংস, নির্যাতনের ব্রক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদ্ধতি, সামরিকায়িত পুলিশ, অতিকায় কারাগার, হাজার হাজার সামরিক ড্রোন আর স্যাটেলাইট—বৈশ্বিক কর্তৃত্বের জন্য গড়ে তোলা এসব যন্ত্রপাতি এবার ব্যবহার করা হবে নিজ দেশে। সাম্রাজ্য ধসে পড়বে। অ্যামেরিকা নিজেই নিজেকে গ্রাস করবে। কর্পোরেট রাষ্ট্রের শাসকদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে না নিলে আমাদের জীবদ্দশাতেই তা ঘটবে।
rofiqahmed publisher