আমেরিকার কোন কোম্পানির মালিকরা বেশি ক্ষমতাবান- তেল, গ্যাস, বন্দুক, ব্যাংক নাকি টেকনোলজি?

1 Answers   12.6 K

Answered 2 years ago

আমেরিকায় যেকোনো ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত ব্যবসাদাররাই খুবই ক্ষমতাবান। কারণ আমেরিকায় আইনগত ভাবে ঘুঁষ দেওয়ার ব্যবস্থা— যাকে পোশাকি ভাষায় বলা হয়- লবি ব্যবস্থা, তা চালু আছে।

এখানে খোলাখুলি ভাবে আমেরিকার বাণিজ্যের প্রতিনিধিরা কোনো আইনের পক্ষে সওয়াল করতে পারেন, বিরুদ্ধে যেতে পারেন, ভোটদানের অধিকারযুক্ত আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করতে পারেন, তাঁদের ভোটের তহবিলে বা কোন সেবা সংস্থায় অর্থ অনুদান দিতে পারেন।

বাণিজ্যিক সংস্থাদের বিভিন্ন সংগঠন সরাসরি দূরদর্শনে বা সমাজমাধ্যমে বিজ্ঞাপন কিনে নির্দিষ্ট আইনের বিপক্ষে বা পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারে।

এসবের প্রভাবে, আমেরিকার বহু আইনই ব্যবসা সংস্থার পক্ষে, যা অনেক ক্ষেত্রে মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী, পরিবেশবিরোধী।

এখন আবার আর দু'টো বিষয় মাথায় রাখতে হবে- সেগুলো হল—

এক, তেল সংস্থা তেলের বিষয়ে আইনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী, বন্দুকনির্মাতা সংস্থাদের লবি (NRA) বন্দুক ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আইন ও নিয়মের ক্ষেত্রে শক্তিশালী। এদের মধ্যে বিরোধ নেই।

অনেক আইনপ্রণেতাদের জনমানসে পরিচিতি আছে- ইনি তেল সেনেটর, ইনি বন্দুক সেনেটর, ইত্যাদি। মানে এঁরা, আইনসভায় ভোটাভুটি উপস্থিত হলে, নিজের ভোট তহবিলে অর্থ দেওয়া সংস্থাদের স্বার্থের পক্ষে ভোট দেন।

দুই, এখন হেজ ফান্ডের যুগ। মানে একদল বিনিয়োগকারী নিজেদের বিপুল অর্থ একজায়গায় করে (হেজ করে) বিভিন্ন সংস্থা ও ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন। তাই এখনকার যুগে তেল লবি, বন্দুক লবি, টেক কোম্পানিদের লবি- এসবের মধ্যে সীমানা ঝাপসা হয়ে আসছে।

দু'টো ক্ষেত্রের কথা আলাদা করে বলতে হবে- সেদু'টো হল- ব্যাঙ্ক আর টেক। ব্যাঙ্ক মানে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক না- ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক। ওই যে মানুষ টাকা হেজ করে, তাছাড়াও অনেক গোষ্ঠী থাকে- যেমন ইউনিয়নভুক্ত ট্রাকচালকদের পেনশনের ফান্ড, জর্জিয়া রাজ্যের শিক্ষকদের পেনশনের ফান্ড- ইত্যাদি। এরা বাজারে টাকা খাটায়। এদের হয়ে সেই কাজগুলো করে দেয় বিভিন্ন অর্থসংস্থা এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক।

এরা ফাটকা খেলতে অভ্যস্ত। মানুষের ভালোমন্দের কথা ভাবে না।

২০০৭-৮ সালে যেমন আমেরিকায় হোম লোনের সিকিউরিটির ফান্ডের উপর ডেরিভেটিভ, আবার তাদের ডেরিভেটিভের ফান্ড তৈরী হয়েছিল অনেক। মোট আসল সম্পদের উপর ডেরিভেটিভ তৈরী হয়ে গেছিল তার চার গুণ। লোন খুব সহজলভ্য হওয়ায় রিয়েল এস্টেট মার্কেট ফুলে ফেঁঁপে বিশাল বাবল তৈরী করেছিল। সেই বাবল ফাটলে ২০০৯ এর বিশ্বজোড়া মন্দা তৈরী হয়। বহু মানুষ পথে নেমে পড়েন, বহু জন আত্মহত্যা করে। এই অপরাধের কিন্তু কোন শাস্তি হয়নি।

আমেরিকার ব্যাঙ্কার এবং অর্থ সংস্থার ভয়ানক ক্ষমতা- এরা ইচ্ছা করলে- একেকটা গোটা দেশের অর্থনীতি বসিয়ে দিতে পারে। কিছু বাস্তব সহ রঙে-রসে মেশানো একটা বই আছে। পড়তে পারেন- Confessions of An Economic Hitman।

আবার এরা ফাটকা খেলে দেউলিয়া হলে সরকার, করদাতাদের টাকায় এদের উদ্ধার করে। পোশাকি ভাষায় একে বলে- বেল-আউট।

এরপর আসে প্রযুক্তি সংস্থার কথা। বিশেষ করে সমাজমাধ্যমদের কথায়।

আমেরিকার সমাজমাধ্যমগুলি এত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে, এবং এত বেশি মানুষ সেগুলি ব্যবহার করে, এই সমাজমাধ্যমে চালাচালই হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একেকটা গোটা জনগোষ্ঠীর জনমত ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।

ভারতে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর আমেরিকায় নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের কেলেঙ্কারির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে।

এদের এত ক্ষমতা- আমেরিকার সরকার এদের কর দেওয়াতে পারে না।

আর আমাদের দেশে যেমন রাজ্যগুলো লগ্নি টানতে ব্যস্ত থাকে, আমেরিকায় সরকারি কাজ বলতে প্রায় কিছুই না থাকায়, বহু মানুষের কর্মসংস্থানকারী হিসেবে এদের দাপট আরও বহুগুণ বেশি। অ্যামাজন কোথায় একটা গুদাম খুলবে বা গুগল কোথায় একটা ডেটা সেন্টার খুলবে, সেগুলো নিয়ে আমেরিকার রাজ্যগুলোর মধ্যে করছাড় দেওয়ার, সুবিধা দেওয়ার রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে।

এখন আবার প্রযুক্তি কোম্পানি গুলো অন্যান্য গতানুগতিক সংস্থাদেরও হাতে নিচ্ছে- যেমন অ্যামাজন গত মাসে মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারকে হাতে নিয়েছে। তাই এদের ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদের হাতে সবচেয়ে ভয়ানক যে সম্পদ আছে- তা হল- আমার আপনার তথ্য। আমরা কী খাই, কী পড়ি, কত বয়স, বিবাহিত, সম্পর্কে আছি, নাকি সিঙ্গল, কোথায় থাকি, কোথায় যাই- সবই এরা জানে। এই তথ্যকে যেকোনো দিন খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার তথ্য বিভিন্ন ডেটা ব্রিচে চুরি যেতে পারে।

তেল, বন্দুক- এগুলো হল প্রাচীন ক্ষেত্র। এগুলো সম্পর্কে ধারণা আইনপ্রণেতাদের আছে। এগুলো অন্তত লোকে বোঝে।

কিন্তু প্রযুক্তি, এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা অধিকাংশ মানুষেরই নেই। একেবারে জটিল ব্যাপার ছাড়ুন, স্বাভাবিক ব্যাপারেও নেই। সেনেটর, কংগ্রেসম্যানরা একই পালের বলদ।

ফেসবুককে বাঁধতে তৈরী করা একটা উচ্চপর্যায়ের কমিটিতে একজন সেনেটর জানতেনই না যে ফেসবুক বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করে এবং তার থেকে আয় করে। উনি খুব আশ্চর্য ভাবে প্রতিষ্ঠাতা জুকারবার্গকে জিজ্ঞেস করেন- "আপনাদের এতকিছু সুবিধা দিতে নিশ্চয়ই প্রচুর টাকা লাগে। তাহলে আপনাদের সব পরিষেবা বিনামূল্যের কীভাবে?"

খানিক অবাক হয়ে জে'বার্গ বলেন-

    "Senator, we run ads."

এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাও সেনেটর জানতেন না। তাহলে এরা আইনপ্রণয়ন করবে কীভাবে?

অর্থব্যবস্থার ব্যাপারেও মানুষ ও রাজনৈতিক- সমান ভাবে অজ্ঞ। দেখেন না ভারতে বিজেপির লোকগুলো ক্রিপ্টোকে ফেলবে না গিলবে- কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না।

তাই এইসব সংস্থাকে আইনের ফাঁক গলেও বেরোতে হয়না। এরা এমন জায়গায় নিজেদের কাজ করে- যেখানে কোন আইনই প্রণয়ন হয়নি। কেউ জানেও না কী কী হয়। এবং আমি এটাকে সামগ্রিক ভাবে খারাপ ভাবে দেখিনা। বিজ্ঞানী আবিষ্কার করার আগে যদি তেলবাবু কি বন্দুকম্যাডামকে বুঝিয়ে আসতে হয় যে তিনি কী করবেন- তাহলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। আর এটা জেনে, অনেক অসাধু লোক সুযোগ ও নেয়। পিটার থিলের সার্ভেইলেন্স কেলেংকারি, প্রেডিক্টিভ পোলিসিং অ্যালগোরিদমের কেলেংকারির বিষয় গুলো খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।

আমেরিকার দক্ষিণের অনেক নেতার সৌদি বা গেরুয়া গোষ্ঠীর মত মনোভাব। এরা মানুষের ভালো চাইবে না। অ্যাবর্শনের অধিকার বানচাল করার, সমকামী অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাজনীতি করে এরা ক্ষমতায় আসবে ভেঁড়া চড়িয়ে, কখনো হিন্দু-মুসলিম করে। দিয়ে এসে আম্বানি, আদানি, bp, থিল, বশদের কাছে দেশ বেচে দেবে। সৌদরা বোরখা বজায় রাখবে, দাড়ির মাপ দেখবে, আর দেশের সম্পদ আমেরিকার কাছে বেচে দেবে- আর তাদের অস্ত্র কিনবে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকায়।

কাদের হাতে মানুষের ভালো বুঝবার ভার- সেসব দেখে দুঃখ হয়। আর অসহায় লাগে।

Huraira Faika
Hurairafaika
436 Points

Popular Questions