আমি যদি ফিলিস্তিনে যেতে চাই, তাহলে কেমন করে যেতে পারি? কী কী সমস্যা হবে বা হতে পারে?
14
0
1 Answers
8.9 K
0
Answered
2 years ago
আপনি কোথা থেকে যাবেন লেখেন নি, বাংলাদেশ হলে সমস্যা আছে। আপনার পাসপোর্ট (সম্ভবত) ইজরায়েল যাওয়ার উপযোগী নয়। আমি ভারতীয় হিসেবে কি উপায়ে কলকাতা থেকে প্যালেস্টাইন গিয়েছিলাম জানাতে পারি।
শর্টে জানতে চাইলে বিমানে কলকাতা-বম্বে-তেল-আবিব তারপরে সড়কপথে প্যালেস্টাইন, সিধে রাস্তা, তবে সওয়া ঘন্টার পথ নয়।
প্রথমেই বলে নিই, আমি কার্যসূত্রে ইজরায়েলে যাই। তাই আমার ওয়র্ক পারমিটের প্রয়োজন ছিল। তার জন্যে আমার এমপ্লয়ার কম্প্যানি দিল্লীর ইজরায়েল দূতাবাসের কাছে আবেদন জানায়। সময়কালে দেখা গেল, আমি ছাড়া কম্প্যানির অন্যান্য সহকর্মীরা ভিসা পেয়ে গেছেন, আর আমার দাড়ির মাহাত্মেই সম্ভবত, আমাকে তলব করা হয়েছে ইজরায়েল দূতাবাসে।
অথ দূতাবাস পর্ব
কি আর করা, এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে চলে গেলাম। দূতাবাসের বাইরে আমাদের কড়া রোদে একঘন্টাটাক দাঁড় করিয়ে রাখা হল। একদম খোলা আকাশের নীচে। একটা গাছের ছায়া অবধি নেই!
দিল্লীর বেদম গরমে দরদর উদ্বেলিত আনন্দধারা নয়, ঘর্মধারায় স্নান করে যখন দূতাবাসকর্মীর মুখোমুখি হলাম, ততক্ষণে আমার সাধের ইস্ত্রী করা শার্ট রাম তেরী গঙ্গা ময়লীর ঝরণাস্নাত মন্দাকিনীর ইষদচ্ছ শাড়ির কাছাকাছি চেহারা নিয়েছে। দূতাবাসকর্মীটি দিব্যি গৌরাঙ্গ, কিন্তু গরমের ফলেই সম্ভবত লাল টকটকে মুখ। তিনি পরুষকণ্ঠ ও রূঢ়স্বরে নানা প্রশ্ন করলেন। মুখ্য প্রশ্ন, আমি কেন ইজরায়েল যেতে চাই।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। দিল্লীতে সেই মুহূর্তে আমি জানতাম না, কিন্তু পরে, প্রচুর ইজরায়েলির সাথে কথাবার্তা বলে, এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা শুনে বুঝেছি, কিছু ইজরায়েলির বাচনভঙ্গিতে কোনো একটা ব্যাপার রয়েছে, যার জন্য তাঁরা ভাল কথা বললেও মনে হয় ঝগড়ার সুরে বলছেন। দূতটির স্বরে আমি যে প্রকট 'হোস্টিলিটি' শুনেছিলাম, তা আদতে রূঢ়তা, না এই বাচনভঙ্গি জনিত ভ্রম, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।কিন্তু সে মুহূর্তে আমি দূতের পরুষ স্বরে প্রকটা রূঢ়তা শুনেছিলাম।
আমি ধৈর্যশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত নই। আর দিল্লীর কাঠফাটা রৌদ্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মেজাজও ততক্ষণে তারসপ্তকে। সিধে জানিয়ে দিলাম, আমার ইজরায়েলে যাবার কোনো বাসনা নেই, কিন্তু আমার কম্প্যানি আমাকে পাঠাতে চায়। আর নেহাত চাকরি খোয়ানোর ইচ্ছে নেই তাই এখানে। নইলে এই গরমে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে কোন শ্লা!
দূতাবাসকর্মী রূঢস্বরে শোনালেন ইজরায়েল মরূদেশ। দিল্লীর গরমে যে ক্লান্ত হয়, ইজরায়েলে তার জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ার কথা। তা আমি মরি কি বাঁচি তাতে তাঁর কৌতুহল নেই, কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে কি করতে চাই, তা নিয়ে তাঁর প্রচুর প্রশ্ন।
আমি আমাদের কম্প্যানির সেলস ব্রোচার দেখালাম, জানালাম আমরা টেলিকমিউনিকেশানের কাজকর্ম করি, ইজরায়েলে আমাদের গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। তাতে তিনি শান্ত হলেন না, আমি ঠিক কি কাজ করব তা তিনি জানতে চান। দূতাবাসের ভিতরের শীতাতপনিয়ন্ত্রকের হিমেল হাওয়ায় আমার মেজাজ খানিকটা জুড়িয়েছে। তাই তাঁর প্রশ্নে মাৎ মাৎ করে খেপে উঠলাম না। শান্তভাবে জানালাম, আমরা কম্প্যানি হিসেবে কি করি তা জানাতে পারি, আমি গবেষণাকেন্দ্রের লোকের থেকে গাণিতিক তথ্যাদি জেনে তার কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখব। কিন্তু এর থেকে বেশী ডিটেল দিতে পারব না। তা কম্প্যানির গোপন তথ্য। আমাকে যেন মার্জনা করা হয়।
ফের প্রশ্ন এল, আমি কি নিশ্চিত, যে আমি যে ঠিকানা দিয়েছি, তার বাইরে আর কোথাও যাব না? আমি তৎক্ষণাৎ জানালাম বিলক্ষণ যাব। একটা আলাদা দেশে যাব, আর তার দ্রষ্টব্য স্থান দেখব না, তা আবার হয় নাকি? তেল-আবিবে কাজকর্ম করব, কিন্তু জেরুজালেমে বিলক্ষণ যাব, আর সময় সুযোগ থাকলে তিবেরিয়াসেও যাব, বেথলেহেমেও যাব, আরও জায়গায় যাব যার নাম পর্যন্ত এই মুহূর্তে জানি না। বলেই খেয়াল হল, জেরুজালেম তো আবার প্যালেস্টাইন, বলা কি উচিত হল? (জেরুজালেম অবশ্য প্যালেস্টাইনে নয়। অন্তত ইজরায়েলের দপ্তরমতে, কিন্তু তখন আমি তা জানতাম না।)
দূত সে পথ মাড়ালেন না। বজ্রগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন জেরুজালেমে আমার পরিচিত কে থাকে? "কেউ কি থাকে?" নয় "কে থাকে?" আমি জানালাম আমার চৌদ্দপুরুষে কেউ ভারতের বাইরে থাকে নি। অধুনা বাংলাদেশ থেকে খেদিয়ে দেওয়ার আগে আমার পিতৃপুরুষ যেখানে থাকত, তা আজ বিদেশ হলেও যখন তারা সেখানে থাকত তা বিলক্ষণ ভারতই ছিল। সে হিসেবে আমার কথা অসত্য নয়। আর ইশকুল-কলেজের বন্ধুরা 'গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্রগামী'। যদিও আমি নিশ্চিত যে ইজরায়েলে শিবপুর বিই কলেজের কোনো না কোনো প্রাক্তনী বিলক্ষণ গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ আমার পরিচিত নয়।
বলেই মনে হল আমার ভিসা বুঝি এইদণ্ডে বাতিল হল। প্রচুর দেশের দূতাবাসে গিয়েছি, মায় কলকাতার কুখ্যাত খিটিখিটে বুড়ী অধ্যুষিত আমেরিকান দূতাবাস, কিন্তু এরকম অভদ্র দূতাবাসকর্মী কোথাও দেখি নি! কিন্তু ভুরু-টুরু কুঁচকে তিনি আমার ভিসা মঞ্জুর করে দিলেন। আমি ভাবলাম গোল কাটল। কিন্তু ঝামেলা সবে শুরু!
কম্প্যানি সস্তার টিকেটের চক্করে দিন কতক কাটালো, তারপরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরিয়ে কায়রো হয়ে এক টিকেট এনে হাজির করল, তার সাথে অল্টারনেটিভ হিসেবে দিল তাশখন্দ ঘুরে তেল আবিব যাওয়ার অপশান! তারপরে আবার কি মনে করে সব বদলে বোম্বাই হয়ে ইজরায়েলি বিমানসংস্থা এল-আল এর টিকেট দিয়ে দিল। ফলতঃ নির্দিষ্ট দিনে আমরা সদলবলে কলকাতা থেকে বোম্বাইগামী প্লেনে চেপে বসলাম।
অথ এল-আল পর্ব
আমার পিতৃদেবের জন্মে কখনও ভারতভূমির ভিতরে এক-টুকরো বিদেশ দেখার সৌভাগ্য হয় নি। কিন্তু এইবারে দেখলাম বোম্বে এয়ারপোর্টের মধ্যেই এল-আলের আলাদা টার্মিনাল। তার বাইরে ভারতীয় সুরক্ষাকর্মীরা চেক-টেক করে ভিতরে ঢুকতে দিল (এক নম্বর সিকিউরিটি চেক), তারপরে ইজরায়েলের রাজত্ব শুরু!! লাইন আর লাইন, মাঝে মাঝে বিরামচিহ্নের মত একটা সিকিউরিটি চেক। শুরু হল ধৈর্যের এক বিশাল পরীক্ষা!
প্রথমে এক জায়গায় বিশাল লাইন, লাইনের শেষে ব্যাগেজ জমা। কিন্তু তার আগে ছোট ছোট কিয়স্কের মত জায়গাতে দাঁড় করিয়ে ব্যাগেজ সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর চলছে(দুই নম্বর সিকিউরিটি চেক)। আমার পালা এলে আমাকে পাকড়াও করলেন এক সুন্দরী তরুণী। শুরু হল আরেক দফা প্রশ্নোত্তর পর্ব। এবারের কৌতুহল আমার ব্যাগেজ নিয়ে। এতে কি আছে? কে এসব ভরেছে? ব্যাগ ভরার পরে আমি কি এই ব্যাগকে চোখের আড়াল করেছি? আমার কাছে যে কম্পিউটার আছে সেটার মালিক কে?
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে দেখা গেল আমার ব্যাগ নিয়ে সুন্দরী সন্তুষ্ট, কিন্তু কম্পিউটার নিয়ে তাঁর মনে খুঁতখুঁতেপনা রয়েছে। কাজেই তিনি আমার পাসপোর্টের সাথে এক হাতে লেখা পোস্ট-ইট স্টিকার এঁটে দিলেন। চোখ বুলিয়ে দেখি হিব্রু লেখা। সহকর্মীটির ভাগ্যেও দেখি জুটেছে সেই হিব্রু লেখা পোস্ট-ইট।
এরপরে লাগেজ চেক-ইন হল, ফের লাইন, তবে ভাগ্যক্রমে এবারে আর প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হতে হল না, কিন্তু আমার চোখের সামনেই লাইন থেকে অচেনা আরেক দাড়িধারীকে, আর আরেকজন পৃথুলা রমণীকে আলাদা করে ডেকে নেওয়া হল। আমরা রেহাই পেলাম। (তৃতীয় দফার পরীক্ষা)। ব্যাগেজ জমা পড়ল। হাতে পাওয়া গেল বোর্ডিং পাস।
এরপরে সাধারণ সিকিউরিটি চেক-ইন (চতুর্থ দফা), সাধারণ সিগারেট লাইটারের খোঁজ করা, পকেট থাবড়িয়ে দেখা ইত্যাদির পরে আমরা প্লেনে চড়ার গেটের কাছে চলে এলাম। সেখানেও দেখি আরেক লম্বা লাইন। এতক্ষণে লাইনে দাঁড়ানোর একটা অভ্যেস হয়ে গেছে।, বিনাবাক্যব্যয়ে লাইনে সামিল হয়ে গেলাম।
খানিক বাদে কালো উর্দিধারী এক সহৃদয় ব্যক্তি এসে আমাদের পাসপোর্টের চিহ্ন দেখে জানালেন, আমাদের জন্য আলাদা লাইন। আমাদের কম্পিউটারের পরীক্ষা করা হবে। অগত্যা পঞ্চম পরীক্ষার মুখোমুখি। যদিও টেকনিক্যালি আমাদের নয়, কমপিউটারের পরীক্ষা। এ পরীক্ষা হল একেবারে বিমানে ওঠার গেটের ভিতরে। বেঞ্চি পেতে বসে থাকা কিছু ব্যক্তি তৎপরতার সঙ্গে কম্পিউটারের কীবোর্ড আলাদা করে ফেললেন, ব্যাটারি খুলে ফেললেন, তারপরে কিছু খোঁচাখুঁচি করে, সব ফের সুচারুরূপে জুড়ে দিলেন। তারপরে ব্যাজার হয়ে সবকিছু ফেরত দিয়ে, আমাকে রওনা করে দিলেন।
অথ তেল-আবিব পর্ব
তেল-আবিব বিমানবন্দরে নেবে আমাদের নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছলাম রবিবার ভোরে।রবিবারে ইজরায়েলে অয়াপিস কাছারি খোলা থাকে, শুক্র-শনিবার বন্ধ। কাজেই অচিরেই অপিস-যাত্রা ও কাজকর্ম শুরু। সে বিষয়ে ব্যাখ্যানা নিষ্প্রয়োজন। কাজেই ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে চলে আসি পরবর্তী এক ছুটির দিনে।
কম্প্যানি থেকে আমাদের একটা ষ্কুদা অক্টাভিয়া ভাড়া করে দিয়েছিল, সহজে অপিস যাতায়াতের জন্য। আমরা জিজ্ঞাসা করে নিয়েছিলাম, এদিক-সেদিক ঘুরতে ব্যবহার করতে পারি কিনা, এবং তাতে কারো আপত্তি ছিল না। কাজেই শুক্রবার পড়লেই আমরা গাড়ি নিয়ে এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়তাম। ইজরায়েল দেশটি আহামরি কিছু বড় নয়, আর রাস্তাঘাট খুব ভালো। তাই দিনে দিনেই সবকটি শহরে ঘুরে ফিরে আসা যাচ্ছিল। আমরাও মহা উৎসাহে আজ মাসাদা ফোর্ট আর ডেড সি, কাল জাফা সৈকত পরশু হাইফা করে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু গোল বাধল বেথলেহেম যেতে গিয়ে। শোনা গেল বেথলেহেম প্যালেস্টাইনের ভিতরে, আর আমাদের ভাড়াকরা গাড়ি, তাই তার প্যালেস্টাইনে ঢোকা বারণ। প্যালেস্টাইনে আলাদা ইনশ্যুরেন্স লাগে, গাড়ি তা সমেতও ভাড়া করা যায়, তবে ভাড়া বেশী।
আমরা খানিক মুষড়ে পড়েছিলাম, কিন্তু এগিয়ে এলেন আমাদের এক ইজরায়েলী সহকর্মী। তিনি জানালেন, কুছ পরোয়া নেহি, প্যালেস্টাইনে পৌঁছে আলাদা গাড়ী ভাড়া করলেই হবে, আর তার দামও কম, সাথে চালকও পাওয়া যায়। আর সবথেকে সুবিধে, এই সমস্ত কম্প্যানির জেরুজালেমেই অপিস রয়েছে, তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। অতএব, চল পানসি বেলঘরিয়া, থুড়ি জেরুজালেম!
অথ প্রথম প্যালেস্টাইন যাত্রা
টুর কম্প্যানি ঢুঁড়ে পাওয়া গেল এক দারুণ প্রস্তাব। গাড়ি ও ড্রাইভারের ব্যবস্থা তারাই করবে। সাথে পুরানো জেরুজালেম ঘুরিয়ে দেখাবে ইজরায়েলী গাইড, পৌঁছে দেবে প্যালেস্টাইন সীমান্তে, সেখান থেকে প্যালেস্টাইনী গাইড আমাদের নিয়ে যাবে বেথলেহেম। খালি একবিন্দু চোনা, প্যালেস্টাইন সীমান্ত যদি রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়, আমাদের কপাল মন্দ। টুর কম্প্যানি কিছু করতে পারবে না। জিজ্ঞাসা করা হল, এরকম কি হয়? উত্তর এল, গাজা সীমান্তে আকছার হচ্ছে, কিন্তু ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক সীমান্তে এমনটা বিরল।
টুর বুক করে ফেলা গেল।
নির্দিষ্ট দিনে টুর কম্প্যানির গাইডের সাথে পদব্রজে জেরুজালেম ভ্রমণ করা গেল, তারপরে কথামত গাইড ইয়েহুদা আমাদে এনে ফেললেন প্যালেস্টাইন সীমান্তে রাচেল চেকপয়েন্ট এ। তারপরে বিশাল পাঁচিল, বন্দুকধারী সুবেশ তরুণ-তরুণী সেনা আর বিশাল বিশাল টার্নপাইক দেওয়া গেটের সামনে লাইনে দাঁড়ালাম। গাইড ইয়েহুদা মানে মানে সরে পড়লেন। ইজরায়েলের বাসিন্দাদের অকারণে প্যালেস্টাইন যাওয়া নাকি নিষেধ।
আমাদের আগেই এক শ্বেতাঙ্গ মার্কিন দম্পতিকে পাসপোর্ট দেখাতে হল। তবে আমাদের দেখে ইজরায়েল-বাসী বলে মনে করা অসম্ভব, কাজেই বিনাবাক্যব্যয়ে প্রবেশাধিকার মিলল। ব্যস, পৌঁছে গেলাম প্যালেস্টাইন।
প্যালেস্টাইনে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে একসার ভাড়ার গাড়ি আর ট্যক্সি। বিদেশী চেহারা দেখেই সম্ভবত বেশ শোরগোল করে তারা ধেয়ে এল। পুরীর পাণ্ডার মত। কিন্তু অচিরেই বাজখাঁই গলায় বিজাতীয় ধমক খেয়ে তারা চটপট সরে পড়ল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন টুর কম্প্যানির প্যালেস্টাইনী গাইড ডেভ। দীর্ঘদেহী, মোটা-চশমাধারী ডেভ ষোলআনা আরব, কিন্তু ধর্মে খ্রীষ্টান। আমাদের পাকড়ে নিয়ে গেলেন তাঁর গাড়িতে। সিধে বেথলেহেম।
বেথলেহেম ভ্রমণকাহিনী বর্ণনা করে লেখা দীর্ঘায়িত করছি না, বরং পরে হেব্রন যাবার বর্ণনা অল্পকথায় সারি। সেবারে টুর কম্প্যানি ছিল না।
অথ হেব্রন যাত্রা পর্ব
শ্রান্ত অথচ তৃপ্ত চিত্তে বেথলেহেম বিজয় সেরে ফেরার পরেই আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা ছকা হচ্ছিল। ফের প্যালেস্টাইনে আসতে হবে, টুর কম্প্যানির পোঁ ধরে নয়, বরং নিজগুণে। ফের বেথলেহেম কেন যাই, তাই খুঁজে বের করা হল আরেক শহর। প্রথমে ভেবেছিলাম রামালা যাব, কিন্তু অপিসের এক জেরুজালেম নিবাসী ব্যক্তি জানালেন রামালা প্যালেস্টাইনের রাজধানী হওয়ার সুবাদে তার পথেঘাটে বেশ ভিড় থাকে। আর দেখার মত নাকি তেমন কিছু নেই। আমাদের যদি বিশেষতঃ রামালাতেই কোনো কাজ না থাকে, তাহলে হেব্রন যাওয়াই ভাল।
অতএব পরবর্তী সুযোগে আমরা চললাম হেব্রন। একই পথে জেরুজালেম, তারপরে সেই একই রাচেল ক্রসিং। তফাৎ এই, যে এর আগে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে পার্কিং খুঁজে আমাদের গাড়ি রেখে দেওয়া হল। রাস্তার ধারে প্রচুর ফাঁকা জায়গা, মুফতে গাড়ি রেখে লোক এদিক সেদিক যাচ্ছেও, কিন্তু অপিসের সহকর্মী পয়সা দেওয়া পার্কিং ছাড়া অন্য কোথাও গারি রাখতে পই পই করে মানা করে রেখেছিলেন। হিসেব মত চেকপয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তা আসলে নাকি প্যালেস্টাইনে, যদিও চেকপয়েন্টের হিসেবে সে রাস্তা ইজরায়েলের দিকে পড়ে। ফলতঃ ওখানে কিছু চুরি হলে তার দায়রা হবে প্যালেস্টাইনে, কিন্তু তদন্ত করবে ইজরায়েল পুলিস। বুঝতেই পারছেন, দস্তুরমত পরিস্থিতি, মানে যাকে বলে পুঁদিচ্চেরি।
এক শেরুৎ বা শেয়ার ট্যাক্সি করে চেকপয়েন্টে পৌঁছানো হল। ভাড়া যতদূর মনে পড়ছে মাথাপিছু বিশ-পঁচিশ শেকেল। তারপরে পাঁচিলের ওপারে পৌঁছে শোরগোল সামলে ভাড়া করা গেল হলদে ট্যাক্সি। ভারতীয় শুনে সহৃদয় ট্যাক্সিচালক নানা খোশগল্প করে নিয়ে গেলেন। শাহরুখ খান তাঁর অত্যন্ত প্রিয়, জানা গেল। তাঁর থেকেই শোনা গেল মার্কিন টুরিস্টের দৌলতে ট্যাক্সিচালকেরা সকলেই বেশ ইংরেজি জানেন। হেব্রনের ওল্ড টাউন দেখার পরে তিনিই আগ্রহ করে অপেক্ষা করলেন, আমাদের ফিরিয়েও আনলেন। খুব ভুল না করলে আপ-ডাউন সব মিলিয়ে সাড়ে চারশ কি পৌনে পাঁচশ শেকেল খরচ হয়েছিল।
তো এই হল বঙ্গসন্তানের দু-দফা প্যালেস্টাইন বিজয়।
মূল অসুবিধে গুলি
১) ভাষা সমস্যা, তবে টুরিস্ট অঞ্চলে ইংরেজী ভালোই চলে।
২) খাদ্যসমস্যা। আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো মাংসেই আপত্তি নেই। কিন্তু গরুতে আপত্তি যাঁদের, তাঁরা সামলে খাবেন। হিব্রুতে চিকেনকে বলে 'অফ' - একদম বাংলা অন-অফ এর অফ। পোর্ক নিয়ে নো চিন্তা! ত্রিসীমানায় পোর্ক পাওয়া যায় না।
৩) সাবাথ!! শনিবারে ধার্মিক ইহুদীদের কাজ করা নিষেধ। আর ইহুদী হিসেবে শনিবার শুরু শুক্কুরবার রাত পড়লে। কাজেই শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সন্ধে পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আগে থেকে অ-ধার্মিক দোকান খুঁজে রাখা দরকার। তেল-আবিব বা তৎসংলগ্ন এলাকা- যেখানে বার-পাব-নাইটক্লাব আদি রয়েছে, সেখানেই পাপী-তাপী লোকের বাস। তা ছাড়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ধারেকাছেও খোলা দোকান পাওয়া যায়। এর বাইরে গেলে ধার্মিকের ঠেলায় সাপ্তাহিক একদিন উপবাস করতে হতে পারে।
৪) টুরিস্ট ঠকিয়ে দুপয়সা কামানোর ফিকিরে ইজরায়েলী-প্যালেস্টাইনী ভাই ভাই হলেও আমাদের (মানে অন্তত ভারতীয়দের) তাদের থেকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশ এ ব্যাপারে ওদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে (নাকি পিছিয়ে বলা উচিত? যাক গে, আমাদের মত অত বড় ঠকবাজ ওরা এখনও হতে পারে নি, যদিও ইয়োরোপ আমেরিকার থেকে একটু বেশীই)।
৫) ড্রাইভিঙ্ এর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা ভাল। ইজরায়েলের পথঘাট ভারতের তুলনায় ভালো। গাড়ী বেশ জোরে চলে। কিন্তু ট্র্যাফিক আইনকে ইজরায়েলীরা ঠিক এখনও 'আইন' বলে ধরে না, মোটামুটি গাইডলাইনের মত ভাবে। পাকা ড্রাইভার না হলে ইজরায়েলে ড্রাইভ করা শক্ত। তবে অপিস টাইমে কলকাতার বাইপাসে যাঁরা গাড়ি চালিয়ে পটু, তাঁদের ভয় করার মত কিছু না।
abutoha publisher