Answered 2 years ago
আপনার কোম্পানি আছে। যেটাকে আপনি ‘ঢেলে’ … এখানে ঢেলে বলতে আপনি কি ঢালাই অর্থে বা নতুন ধাঁচে বলতে চাইছেন। আমি সেই রকম ধারণা থেকে বলছি।
কোম্পানি বলতে একটি আইনত বৈধ ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। যে কিছু তৈরী করে, কেনা-বেচা করে, পরিসেবা দেয় এবং সরকারকে নায্য কর দেয়। তা একটি ১০x১০ ফুটের ঘরে বসেও হতে পারে। একটি দোকান, একটি গোডাউন, একটি শেয়ার করা অফিসে একটি টেবিল থেকেও হতে পারে। সরকারি খাতায় সবই কোম্পানি। আপনার একজন কর্মচারী না একশো জন কর্মচারী যেমনই হোক না কেন।
এই কোম্পানি যখন কাজ করে, তখন নানাবিধ গতিবিধি এখানে হয়ে থাকে। এই প্রত্যেকটি গতিবিধি কোম্পানি নিজের লাভের জন্য করে থাকে। প্রত্যেকটি গতিবিধির পেছনে একটি সিদ্ধান্ত থাকে। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের পর পদক্ষেপ নিয়ে তাকে লাভে পরিবর্তিত করার উদ্দেশ্য প্রত্যেক কোম্পানির দৈনন্দিন কাজ।
এই কোম্পানি বা একটি ব্যবসায়ীক সংগঠনকে বিভিন্ন ভাবে বর্গিকরণ করা হয়। যে কোনো দেশের সরকার তার বিভিন্ন মানক রাখেন একটি কোম্পানিকে চিহ্নিত করতে। অত্যধিক ছোট, ছোট, ছোট-মাঝারি, মাঝারি, বড়, খুব বড় উদ্যোগ ইত্যাদি। Micro, Small, Medium, Large ইত্যাদি শুনে থাকবেন, যা বিভিন্ন কোম্পানির ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে।
কোন কোম্পানিকে কি বর্গে নেওয়া হয় ও কিভাবে নেওয়া হয়, তার বিভিন্ন মানক হলো, কত টাকার ব্যবসা, কতজন কাজ করে, কি ধরণের কাজ করে, কতটাকা কর দেয়, কত পুরানো প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনি উল্লেখ করেছেন যে আপনার একটি কোম্পানি আছে। এখন আপনার কোম্পানি, মানে বর্তমানে আপনার কোম্পানি কোন বর্গে পড়ে। ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি, বড়.. কি রকম তার বহর। বাৎসরিক কত টাকার ব্যবসা করে, কতজন কাজ করে, এই বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার কোম্পানির মালিকানা কি রকম? একজন না একাধিক? আপনার কোম্পানিতে ডাইরেক্টর কতজন, আপনার কোম্পানির আর্থিক পরিকাঠামোটা কি রকম? এই বিষয়গুলি হবে গুরুত্বপূর্ণ।
কেন?
ধরুন একটি ৮ বছরের শিশু বাবা হতে চায়। তাহলে তা কি সম্ভব? না। কারণ তার শারীরিক সংরচনা এখনো তার জন্য পরিপক্ক নয়। এটা হলো বাস্তবিকতা। ঠিক তেমনি একটি কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কর্পোরেট কথাটা আজ থেকে ২৪/২৫ আগে ভারতে খুব একটা প্রচলিত ছিলো না। মনমোহন সিং যখন উদারীকরণ করেন, তার কিছু বছর পর এবং বিশেষ করে প্রযুক্তির প্রসার হওয়ার পর এই শব্দটি যুবা বর্গের মুখে মুখে প্রচার প্রসার পায়। শব্দটি কর্পোরেশন শব্দ থেকে এসেছে। এর বাংলা হবে সংস্থা( আমি নিশ্চিত নয়)। আপনার কাছে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, আর আপনি তাকে একটি সংস্থান করে তুলতে চাইছেন।তাহলে প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পার্থক্য কি?
একটি প্রতিষ্ঠান নিজের বহর অনুযায়ী নিজের সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ, কার্য্যপ্রণালী ইত্যাদি নির্ধারিত করে থাকে। তার লাভের হিসাব ঠিক রাখার জন্য সে নিজের কার্য্যপ্রণালী অনেক সময়ই পরিবর্তন করে থাকে। সে নিজের কর্মচারীকে লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে থাকে। মানে, একই কর্মচারী বিভিন্ন রকমের কাজ করে থাকে। এই সব সিদ্ধান্ত একজন বা একাধিক জন নিয়ে থাকেন, কিন্তু তার কোনো স্থিরতা থাকে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী লাভের উদ্দেশ্যে তা নিয়ত পরিবর্তিত করা হয়ে থাকে। scales of economy হলো তার মুল কারক। সাশ্রয় দিয়ে কথা। যেমন লাভ, তেমন খরচ তেমন কাজ/পদক্ষেপ।
যদি একটি খুব ছোট প্রতিষ্ঠান যার বাৎসরিক ব্যবসা খুব বেশী নয়, এবং খুব বেশী লোক কাজ করেন না, সে যদি একটি সংস্থানের অনুরুপ কাজ করার চেষ্টা করে, তার কিছু মৌলিক ব্যায় বৃদ্ধি হবে। হয় তার খরচ বাড়বে, হয় তার সময়ের অপচয় হবে, আর না হলে তার productivity (বাংলা জানি না) কমে যাবে। এই তিনটি পরিস্থিতি-ই তার জন্য কাম্য নয়। হতে পারে না। যদিও এই গুলি করতে পারা হলো ‘আদর্শ কার্য্যপদ্ধতি’।
একটি প্রতিষ্ঠান কি ভাবে কাজ করে, বা তার কার্য্য পদ্ধতির গুণগত মান, তার নিয়মাবলী, নিয়মানুবর্তীতা, অনুশাসন, আইনত বৈধতা, পারদর্শীতা, বিভাগীয় অনুশাসন ইত্যাদি কিছু মানক, যার দ্বারা তাকে চিহ্নিত করা হয়। আপনি ISO, DNV সার্টিফিকেশন ইত্যাদি শুনেছেন, বা বিভিন্ন কোম্পানির নামের সাথে এর উল্লেখ দেখে থাকবেন। অমুক কোম্পানি ISO certified বা DNV সার্টিফাইড ইত্যাদি। এইগুলি ইঙ্গিত করে যে প্রতিষ্ঠানটি উপরিউল্লিখিত বিষয়ে নিজের গুনমান রক্ষন করে।
যখন আপনি এই সার্টিফিকেশন প্রদানকারী সংস্থান গুলির কাছে আপনাকে সার্টিফাই করার জন্য আবেদন করেন, তখন এদের প্রতিনিধি আপনার প্রতিষ্ঠানে এসে আপনার কার্য্যপ্রণালীর পরিস্থিতি, যথার্থতা ইত্যাদি খুটিয়ে দেখেন। এবং যেমন পরিস্থিতি হয় তার অনুরুপ আপনাকে A, B, C ইত্যাদি বর্গে চিহ্নিত করেন। এরপর যদি পরের বছর আপনি আগের তুলনায় আরো পরিচ্ছন্ন ও পারদর্শীতার সাথে নিজের কার্য্যপ্রণালী কে চালনা করেছেন, তাহলে তদানুরুপ আপনাকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এরা আপনার কোন বিষয়গুলিকে জাচাই করেন
আপনার কোম্পানি কি করে, নির্মাণ করে না পরিসেবা দেয়। তার জন্য প্রযোজ্য আইন পালন হয় কি হয় না।
আপনি আপনার নির্মিতির প্রক্রিয়াগত গুনবত্তা ঠিক রাখেন কি না। আপনার উপর পরিবেশ দুষনের কোন আইন প্রযোজ্য। আপনি তা পালন করেন কি না। আপনি যদি পরিসেবা দেন তাহলে তার জন্য প্রযোজ্য আইন মানেন কি মানেন না। আপনার প্রতিষ্ঠানে কতজন কর্মচারী। তার অনুরুপ আপনার উপর কোন আইন প্রযোজ্য। আপনি তা পালন করেন কি না। আপনার প্রতিষ্ঠান নিজের কর্মচারীদের কি রকম পরিবেশ, পরিস্থিতি দেন। তাদের শরীর সাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে না নেই। তাদের মৌলিক কিছু অধিকার আছে, তা আপনি বজায় রাখেন কি না। তাদের বেতন কিভাবে, কবে দেওয়া হয়।
আপনার প্রতিষ্ঠানে,বিভাগীয় তথ্যের আদান প্রদান কি ভাবে হয়। আপনার ব্যবসায়ীক বহর অনুযায়ী কাজের দায়ীত্ব ভার সঠিক ও সন্তুলিত ভাবে বন্টন করা হয়েছে কি না। কোম্পানির প্রবন্ধন কি কোম্পানির কর্ম প্রক্রিয়া পদ্ধতির উল্লেখ যোগ্য বিসঙ্গতি নিয়ে জানতে পারেন, বা অবগত হওয়ার পদ্ধতি রেখেছেন।
আপনার কোম্পানি যখন কিছু কেনেন, তার পদ্ধতি কি। তুলনামূলক কোটেশন, পার্চেজ অর্ডার, ডেলিভারি নোট, গেইট পাস, ইনভেন্ট্রি ইত্যাদির প্রবন্ধন কি রকম। আপনি নিজের সাপ্লায়রকে সঠিক সময়ে বা চুক্তি অনুযায়ী টাকা সঠিক পদ্ধতি তে দেন কি না। আপনার কাছে আপনার স্টোর প্রবন্ধনের পদ্ধতি আছে কি না। আপনি যেই সব জিনিস expire করে গেছে, তাকে কি ভাবে dispose করেন। তার জন্য আপনার উপর কোনো নিয়ম প্রযোজ্য কি না, আপনি তা পালন করেন কি না।
আপনি বিদ্যুৎ , জল অপচয় করেন কি না। আপনি পরিবেশ দুষন করেন কি না।অগ্নি সমন, সুরক্ষার ব্যবস্থা যথোচিত কি না। আপনি বাৎসরিক সব সার্টিফিকেট নবীনিকরন করিয়ে রাখেন কি না। আপনার বিরুদ্ধে কোনো সরকারী নোটিস আছে কি না।
আপনার দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, বার্ষিক রিপোর্টের প্রক্রিয়া কি। তার উপর কি ভাবে আপনি সংশোধনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। আপনার কাছে আপনার গ্রাহক বা অন্য পরিসেবা প্রদানকারী যদি নালিশ/ অভিযোগ করে, তাহলে তাকে আপনি কিভাবে সমন করেন, কতদিনে করেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনার কোম্পানির ওয়েবসাইট আছে কি না। তাতে সঠিক তথ্য দেওয়া আছে কি না। তাকে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যে আপডেট করা হয় কি না। প্রবন্ধনকে সম্পর্ক করা যায় কি না ইত্যাদি।
যদি আপনি উল্লিখিত সব বিষয়ে একদম সঠিক ও সর্বমান্য গুনগত মান পালন করেন, এবং আপনার বহর একটি নিশ্চিত বর্গের উর্দ্ধে হয়, আপনার বিগত কিছু বছরের লাভ উর্দ্ধমুখ, আপনার প্রতিষ্ঠান এক ব্যক্তি কেন্দ্রীক নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে একাধিক, যোগ্য অনুভবী ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া হয়, তাহলে আপনি বাজারে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে লগ্নী করার টাকা পাবেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ( অর্থনৈতিক অথবা বে-অর্থনৈতিক) আপনার প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্মিলিত হবে। তখন আপনি একটি সংস্থানে পরিবর্তিত হবেন। কারণ যারা আপনার উপর টাকা লগ্নি করবেন তারা সুরক্ষিত বোধ করবেন। যারা কাজ করবেন তারা এবং আপনার গ্রাহক সবাই আপনাকে পারদর্শী মনে করতে সক্ষম হবেন।
এই সব কাজ করতে আপনার কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
১. উদ্দেশ্য/ পরিকল্পনা
২. সংশাধন
৩. কার্য্যত কার্যকর করা।
৪. পর্যবেক্ষন
৫. উন্নয়ন ও পরিশোধন
আবার থেকে ১ থেকে ৫। এটি প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ দুইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যখন আপনি বহরে ছোট আপনি শুধু কম্পিউটারে কাজ করে নেন। যখন আপনি মাঝারি থেকে বড় হয়ে যান তখন আপনি বিভিন্ন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করেন।
যখন আপনি নিজের বিস্তার করতে চান তখন আপনি বিভিন্ন বিভাগে উপযুক্ত অনুভবী ব্যক্তিকে রাখেন। তখন আপনাকে বিভিন্ন পদ্ধতি কার্যকর করতে হয়। সুদক্ষ ব্যক্তির হাতে আপনি পর্যবেক্ষন দেন। বিভিন্ন রিপোর্টের সাহায্য নিয়ে কোম্পানির কার্যত অবস্থা বোঝেন। তার অনুরুপ সিদ্ধান্ত নেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরামর্শদাতা কে কাজে লাগান।
তাহলে, যে কোনো কোম্পানি ও কর্পোরেট কাজ একই করে, কিন্তু কার্য্যপ্রণালী, পদ্ধতি ও তার উপস্থাপনের ভিন্নতা ও তার বহর তাকে পৃথক করে। এইসব কিছু করতে একটি খরচ বহন করতে হয়। আপনাকে আলাদা বিভাগ সৃষ্টি করতে হয়, process & quality excellence ইত্যাদি। যারা প্রত্যেক বিভাগের কার্য প্রণালীর উপর চোখ রাখে। অনেক সময়ই এই কারণে বিভাগের প্রবন্ধকার ও প্রক্রিয়ার প্রবন্ধকারের মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দেয়। বিশেষ করে ভারতের বাইরে আমার তেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। যদিও আমি নিজে ভীষণ ভাবে নিয়ম রক্ষার পক্ষপাতী। অন্তত ছোট ব্যবসাতেও যতটা সম্ভব আদর্শ প্রক্রিয়া কে ধরে রাখার পক্ষপাতী। এতে পরবর্তী সময়ে সেই ব্যবসায় টাকার নিবেশ আনা, বা অতীব লাভে সেই ব্যবসা বেচে দেওয়া, সবই সম্ভব হয়।
আশা করি একটি বৃহৎ বিষয়ের সংক্ষেপে, প্রাথমিক ধারণা দিতে পারলাম।
rafirayhan publisher