Answered 2 years ago
২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯
তখন আমরা সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ২১ বছরের টগবগে যুবক, সবসময় এডভেঞ্চারের খোঁজে থাকতাম তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার ২ মাসের মাথায় ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যাই। তখন আমার কাছে সবসময় নাম মাত্র মূল্যে কেনা একটা সেকেন্ডে হ্যান্ড ফুযি ক্যামেরা থাকতো। সেই ক্যামেরায় কে যেন সেদিন এই ছবিটি তুলে দিয়েছিল। প্রায় ৫২ বছর পর আজ সেই ছবির নেগেটিভ ডেভেলপ করলাম।
তখন আমার এই ফ্রেন্ডসার্কেলে ছিল বায়োজিদ, আজহার, পাঠান, রাহাত। সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ১ বর্ষের ছাত্র আমরা।
ফটো ফ্রেমে সানগ্লাস পরা যে ছেলেটা আমার ডান হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ওর নাম বায়োজিদ। ১৯৭১ এর যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই ও আমেরিকার পেন্সিলভেনিয়ায় চলে যায়। এরপরও বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল কিন্ত যুদ্ধের পর ওর পরিবারও আমেরিকায় চলে যাওয়ায় আর পরে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। তখন তো আর আজকের মত এত সহজে চাইলেই যোগাযোগ করা যেত না। সেসময় ফোন, ইন্টারনেট এসবের কিছুই ছিল না। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তখন চিঠি। তাই না চাইতেও আস্তে আস্তে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। এখন ও কোথায় আছে ঠিক জানিও না।
ফটো ফ্রেমের যে স্বাস্থ্যবান ছেলেটা আমার বাম হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওর নাম আযহার। তখন ঢাকার মধ্যে ওদের মতো বিত্তবান পরিবার খুব কমই ছিল। ঢাকার গুলশানে আজিজ মোটরস নামে গাড়ির শোরুম ছিল ওদের। যুদ্ধ শুরু হবার পর পরিবার সহ ওরা সবাই পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায়। সেই থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এরপর অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি। জানামতে পাকিস্তানের লাহোরে ওর দাদাবাড়ি ছিল। ওরা সম্ভবত ওখানেই গিয়েছিল। আমি সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে লাহোরে একটা ব্যাবসায়িক কাজে গিয়েছিলাম। সেসময় ওদের খোজার চেষ্টা করেছি অনেক কিন্তু পাইনি। যতটুকু মনে হয় ওরা পাকিস্তান থেকে পরবর্তী সময়ে অন্য কোন দেশে চলে গিয়েছিল।
যে ছেলেটা আমার ডান পা ধরে ছিল ওর নাম হাসিবুল হাসান পাঠান। প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ৩ বর্ষে এসে বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপ আউট হয়েছিল। অনেক বুঝিয়েও পরে আর পড়াশোনায় আনতে পারিনি। ড্রপআউটের পর ও ওর বাবার সুতার ফ্যাক্টরি সামলানোর দায়িত্ব নেয়। ১৯৭৩ সালের দিকে ওদের ব্যাবসায় ধ্বস নামে। ফ্যাক্টরি নিলামে ওঠে। এরপর থেকে আর কোন যোগাযোগ নেই।
আমার বাম পা ধরে থাকা যে লম্বা চুলের ছেলেটাকে দেখছেন ছবির একদম ডানে ওর নাম ইফতেখার রাহাত। যুদ্ধের সময় ৩ নাম্বার সেক্টরে যুদ্ধ করেছিল। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ওই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধের পর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা কন্টিনিউ করে। ও তখন রীতিমতো ক্যাম্পাসের হিরো। বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। রাজনীতি, যুদ্ধে অংশ নেওয়া এসবের জন্য ও ৩ বছর ইয়ার ড্রপ খায়। পরবর্তীতে অনার্স পাশ করে কোথায় কি করতো তা আর জানতাম না তবে ও এখন পরিবার সহ ঢাকার বনানীতে আছে যতটুকু শুনেছি।
এই ছিল আমার ফটো ফ্রেমের মানুষগুলো। যাদের ৩ জনকে হারিয়ে ফেলেছি। জানি না কোথায় আছে এখন তারা। বিশেষ করে পাঠানের কথা মনে পরে। ওর আর দীপার জুটি তখন ক্যাম্পাসের সেরা জুটি। অর্থ বিত্ত সব কিছু থাকার পরেও শেষ পর্যন্ত পাঠান দীপাকে আর পায়নি। সেই কষ্টে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায় পাঠান।আর দীপা বিয়ের পর লন্ডনে চলে যায় হাজবেন্ড সহ৷ এখনো দীপার সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। ফেসবুকে দীপার নাতি নাতনিদের ছবি দেখি মাঝে মাঝে।
বিত্তবান হবার পরও শেষমেশ ফ্যাক্টরি বসে যাওয়ায় পাঠানদের সাংঘাতিক অর্থনৈতিক টানাপোড়েন পরতে হয়েছিল। এরপর কিছু বছর মুহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে একটা ভাড়া বাসায় তারা পরিবার সহ থাকতো শুনেছিলাম।
আমার ফ্রেন্ডসার্কেলের মধ্যে এক আজহারেরই ছিল দুই দুইটা গাড়ি। ক্যাম্পাসে সবসময় মার্সেডিজ বেঞ্জ রোডস্টার ৪৫০ নিয়ে আসতো। কিন্তু এক সময় এই শখের গাড়ি, বাড়ি, গ্যারেজ সব রেখেই দেশ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যেতে হয় ওদের। আজহারের সেই সিলভার কালারের মার্সেডিজ বেঞ্জের ভাঙাচোরা অবশিষ্টাংশ এখনো হয়তো দেশের কোথাও না কোথাও অযত্নে পরে আছে কিন্তু আজহার আর নেই।
বায়োজিদ হয়তো বা আমেরিকার কোন জাগায় এখনো বসবাস করছে। ফেসবুকে অনেক খুজেছি কিন্তু পায়নি৷ বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। তবে এখন খুব জানতে ইচ্ছা করে ও বেচারা বিয়ে করেছিল কিনা শেষ পর্যন্ত। আমাদের সাথে যখন থাকতো তখন খুব বলতো ও আজীবন একাই থাকবে, আরামে জীবন কাটাবে। বিশেষ প্রয়োজনে লাসভেগাস যাবে কিন্তু বিয়ে করবে না।
আর বাকি থাকে রাহাত। ওর মত রোগা পটকা, চোখে পাওয়ার ওয়ালা মোটা ফ্রেমের চশমার এই ছেলেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে যা আমাদের সবার কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। ৪ জনের টিম নিয়ে হবিগঞ্জের একটা ব্রিজ উড়ানোর গল্প ওর মুখে আমার হাজারবার শোনা। ওর মতো সহজসরল ছেলেই পরবর্তীতে সামনে থেকে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু সেই টগবগে রক্তের যুবক রাহাত এখন আর আগের মতো টগবগে নেই। বনানীর একটা ফ্ল্যাটে এখন সে শয্যাশায়ী।
সময় কতো দ্রুতই না বয়ে যায়!
মনে হয় ছবিটা ৫২ বছর আগের না বরং সেদিনের তোলা। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে TSC এর সামনে দাড়াই মনে হয় এইতো একটু পর আজহার ওর মার্সেডিজ বেঞ্জ নিয়ে ধোয়া উড়াতে উড়াতে চলে আসবে। মধুর ক্যান্টিনে বসলে মনে হয় সেই কালো চারকোনা সানগ্লাস পরে বায়োজিদ এখনই আসবে ওর ফেভারিট স্টার সিগারেট কিনতে। বটতলায় গেলে মনে হয় হয়তো ওদিকেই পাঠান দিপার সাথে বসে আছে। আমাকে দেখলেই আগের মতো বলে উঠবে, আরে মামা কি অবস্থা? চল রাজুর ওখানেই যাই। সাদেক মামার তেতুল চা খেয়ে আসি।
আফসোস তারা এখন কেউই নেই। সময় কতই না দ্রুত বয়ে যায়। যদি আরেকবার সেই ২ ফেব্রুয়ারির দুপুরটা পেতাম!
Piku publisher