Answered 2 years ago
আমার দাদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। দাদা দেখতে ভীষন সুন্দর ছিলেন। একদম নায়ক উত্তম কুমারের মতো। দাদার গায়ের রঙ ছিলো ফর্সা। উঁচা লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। দাদা থাকতেন বিক্রমপুর। লেখাপড়া শেষ করে কলকাতাতেই ব্যবসা করতেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কলকাতা বৈঠকখানা রোডে ছিলো। দাদা বৈঠকখানা রোডে একটা দোতলা বাড়ি কিনে ফেলেন। সেই বাড়ি এখনও আছে। আমার এক চাচা সেই বাড়ি উদ্ধারের অনেক রকম চেষ্টা করেছিলেন। ফলাফল লাখ লাখ টাকা খরচ। দাদার ব্যবসা ছিলো নিউজ প্রিন্ট কাগজের। আমার জন্মের আগেই আচমকা দাদা অন্ধ হয়ে যান।
দাদাকে সবাই জমিদার বলে ডাকতেন। তার চাল চলন, কথাবার্তা এবং খরচের হাত ছিলো অনেক। অনেক বিষয় সম্পত্তি ছিলো। জমি ছিলো মাইলের পর মাইল। এমনকি আড়ই বিলের অর্ধেক ছিলো আমার দাদাদের। গ্রামের লোকজন দাদাকে বলতো নওসা মিয়াঁ। আমি যখন ছোটবেলা গ্রামে যেতাম গ্রামের লোকজন আমাকে বলতো নওসা মিয়ার নাতী। আমাদের একটা জমিদার বাড়ি ছিলো। যার বয়স ১২০ বছরের বেশি। ভগ্ন দশা। দাদা অন্ধ হওয়ার পর বললেন, এই বাড়িতে আমি থাকবো না। এ বাড়ি ভেঙ্গে যাবে যেকোনো সময়। আমি অন্ধ। আমি দৌড় দিতো পারবো না। আমার জন্য একটা কাঠের দোতলা বাড়ি বানাও। একটা কাঠের দোতলা বাড়ি তৈরি করা হলো। সেই বাড়িতে আমি ছোটবেলায় যেতাম, থাকতাম। এখন অবশ্য কাঠের দোতলা বাড়িটা নেই।
আমার দাদার ভাগ্য খারাপ। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আমার দাদা হঠাত অন্ধ হয়ে যান। দেশ বিদেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়ে চোখ আর ঠিক হয়নি। বাকি ৩৫ বছর দাদা অন্ধ হয়ে রইলেন। তখন দাদার মোট ৯ জন ছেলেমেয়ে। সবাই ছোট ছোট। দাদার পাসপোর্টে লেখা ছিলো ল্যান্ড লর্ড। দাদার কেনা কলকাতার সেই বাড়িটা এখনও আছে। কিন্তু আমাদের দখলে নেই। দাদা কোনোদিন সেলুনে গিয়ে চুল দাঁড়ি কাটেন নি। নিতাই নামে এক পারমানিক (নাপিত) এসে মাসে দুবার দাদার চুল দাঁড়ি কেটে দিয়ে যেতেন। আমার মনে আছে, আমি গ্রামে গেলেই দাদা আমাকে নিয়ে বিকেলে পদ্মানদীর পাড়ে হাঁটতে যেতেন। দাদা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পড়তেন। হাতে আঙ্গুলে ছিলো অনেক গুলো সোনার আংটি। দাদা তার ছোটবেলার গল্প বলতেন তখন। পদ্মা নদীতে গোছল করেছেন। মাছ ধরেছেন। নৌকায় করে ফরিদপুর যেতেন।
ছোটবেলা আমি বছরে দুবার গ্রামে যেতাম। তখন ঢাকা থেকে বিক্রমপুর যেতে অনেক সময় লাগতো। ৬/৭ ঘণ্টা। এখন তো দেড় দুই ঘণ্টায় চলে যাওয়া যায়। দাদা অন্ধ হয়ে গেছেন। সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে থাকেন। কানের কাছে একটা রেডিও সারাদিন থাকে। দাদী ছাড়া দাদার কছে কেউ খুব একটা আসে না। আমি দাদার কাছে গেলে দাদা হাত দিয়ে আমার নাক ধরতেন। বলতেন নাক তো আমার মতো হয়নি। শরীর স্বাস্থ্য এত খারাপ ক্যান? মনজুর মা বলে কাউকে ডাকতেন। (পড়ে জেনেছি, মনজু নামে আমার এক ফুপি ছিলেন। তিনি জন্মের এক বছর পর মারা যায়।) দাদী এসে সামনে দাড়াতো। তখন দাদা দাদীকে বলতেন- পুকুরে ঝাল ফেলো। মনাকে বাজারে পাঠাও। নাতী এসেছে আমার। মনা সব সময় দাদার কাছে থাকতো। মনা বিয়ে করেনি। গ্রামে যাওয়া মানে খাওয়া। নিজের ইচ্ছায় নয় দাদা দাদীর ইচ্ছায়। প্রিয় মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের অনেক গুলো মাধ্যমের একটা হচ্ছে তাকে জোর করে খাওয়ানো।
দাদার কাছ থেকে আমি কিছুই শিখিনি। একজন অন্ধ মানুষের কাছ থেকে আর কি শিখবো? অন্ধ হওয়ার পর দাদা দুজনকে আপন করে নিয়েছিলেন। এক, আমার দাদী। দুই, রেডিও। এই ছিলো তার দুনিয়া। কারন তার ছেলে মেয়ে আর নাতী নাতনী থাকতো শহরে। একসময় দাদাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু ঢাকাতে দাদার ভালো লাগে না। সে যাই হোক, যে কথা বলছিলাম- দাদার কাছ থেকে কি কি শিখলাম? একেবারেই কি কিছু শিখুনি? জিনগত অনেক কিছুই তো বংশগত ভাবে পেয়েছি। দাদা সময় মতো সব করতেন। খাওয়া, গোছল, ঘুম। দাদা রাত আট টায় নিজের হাতে দরজায় খিল দিতেন। তারপর এই খিল আর কারো খোলা নিষেধ। দাদা খেতে পছন্দ করতেন। দাদা সাত পদ সামনে নিয়ে খেতে বসতেন। সাত পদের কম রান্না হলো খুব চিল্লাচিল্লি করতেন। দাদার একটা খাট ছিলো। এরকম খাট আমি আরা কোথাও দেখি নাই। ভুল বললাম, দেখেছি। যাদুঘরে দেখেছি। অনেক উঁচু খাট। তিনটা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে খাটে উঠতে হতো। দাদার একটা বন্ধুক ও সিন্ধুক ছিলো।
দাদা ঢাকা আসতেন মাঝে মাঝে। আমাদের বাসায় উঠতেন। আমি দাদাকে নিয়ে হাঁটতে বের হতাম। দাদার মাথার সমস্ত চুল সাদা। হাতে একটা লাঠি। দাদা ধূমপান করতেন না। সারাদিন রেডিও শোনার কারনে দেশ বিদেশের সব খবর তিনি জানতেন। দাদার ছেলেমেয়েরা দাদাকে খুবই ভয় করতো। একমাত্র দাদী দাদাকে ভয় করতেন। দাদা দাদীকে আদর করে ভাই বলে ডাকতেন। ভাই বলে এক চিৎকার দিতেন। তখন দাদী বুঝতে দাদা কি চাচ্ছেন। দাদাকে ছেড়ে দাদী কোনোদিন কোথাও যাননি। দাদা তার অনেক গুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে শুধু তার বড় ছেলের সাথেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। দাদার বড় ছেলেই আমার আব্বা। আমার আব্বার মধ্যেও দাদার মতো জমিদারি ভাব ছিলো। যাইহোক, লেখা অনেক লম্বা হয়ে গেছে। পড়ে কখনোও দাদীর কথা বলব। বেশ ইন্টারেস্টিং কাহিনী। দাদী ছিলেন একেবারে অন্যরকম মানুষ।
Sazib publisher