Answered 3 years ago
বিজ্ঞান সীমাবদ্ধ, অক্ষম এটা প্রমাণের জন্য একটা যুক্তি খুবই বিখ্যাত হয়েছে। অনেকের কাছেই বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার যুক্তি হিসেবে উপরের প্রশ্নটা শুনেছি। এই প্রশ্নটা আমি রূপক হিসেবে নিলাম। আমি আলোচনা করব পুরো অপরাধ জগতের মূল নিয়ে। এর আগে অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সোশ্যাল সাইন্সের বিষয় টেনেছেন যেমন: অপরাধবিজ্ঞানও এক ধরনের বিজ্ঞান ইত্যাদি। আমার কাছে এই যুক্তিও সীমাবদ্ধ মনে হয় কিছু কারণে। এই যুক্তি প্রাণিজগতে কীভাবে অপরাধ আসলো সেটা নিয়ে কোনো আলোচনাই করে না। আর এই জিনিসটাই বোঝা দরকার আমাদের যে অপরাধের উৎপত্তি কীভাবে হলো। নয়তো প্রশ্ন থেকে যাবে নেচারাল সাইন্স যেমন সব প্রাণীর জন্য এপ্লিকেবল, সমাজবিজ্ঞানও কী তাই? এজন্য আজ আমরা জীববিজ্ঞান তথা ন্যাচারাল সাইন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করব কেনো একজন ধর্ষক তথা অপরাধীর শাস্তি প্রয়োজন।
আজকে আমি শোনাব আমাদের অতীতের গল্প। বিবর্তন নিয়ে যারা টুকটাক পড়াশুনা করেছেন তারা হয়তো একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন। নেচারাল সিলেকশনের মূল ট্যাগলাইন এমন-
"Fit enough to survive upto breeding."
এর অর্থ- আপনি যদি টিকে থাকতে চান প্রকৃতিতে, আপনাকে যথেষ্ট উপযুক্ত হতে হবে এবং প্রজনন ঘটাতে হবে। অন্যদের তুলনায় উপযুক্ততায় এগিয়ে থাকতে হবে। জৈবিক প্রয়োজন মিটানোতে (যেমন পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহ), কিংবা ঝড়-বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় টিকে থাকায় যে যত বেশি দক্ষ হতে পারবে তার টিকে থাকার সুযোগ বাড়বে। এখন একই প্রজাতির সব প্রাণী যখন একই ধরনের খাদ্যের পিছনে ছুটবে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। খাদ্যের সীমাবদ্ধতা, বংশবৃদ্ধির জন্য সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার মতো জৈবিক চাহিদাগুলো এই অন্তঃপ্রজাতিক প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দেয়। এই প্রতিযোগিতা প্রকৃতির এক নিষ্ঠুরতা বলা চলে। কিন্তু এই নিষ্ঠুরতম প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে সহিংসতার হাত ধরে উৎপন্ন হয় সহমর্মিতার, সহযোগীতার। আমরা আমাদের তুলনায় অনেক ছোট স্কেলের প্রাণীদের স্বভাব বৈশিষ্ট্যেও সহযোগীতার বিষয়টা দেখতে পাই। যেমন: বাঁদুড়েরা নিজেদের মধ্যে খাদ্য ভাগাভাগি করে খায়। বানর বা গরিলাদের মধ্যে সহমর্মিতার বিষয়গুলো আরও পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করা যায়। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে, আমি রেফারেন্সে যে বইগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো পড়ে দেখবেন, আরও বিস্তারিত সাজিয়ে লেখা আছে।
জীববিজ্ঞানে হ্যামিলটনের সূত্র নামে একটা সূত্র আছে যেটা প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে উৎপন্ন সহমর্মিতা বা পরার্থিতা ব্যাখ্যা করে। সূত্রটা এমন:
b > c/r
বা, br - c > 0
এখানে, b হলো benefit received by recipient.
r হলো coefficient of relationship.
c হলো cost of altruism.
উদাহরণ দিয়ে বুঝাই জিনিসটা। ধরুন, একটা সিংহীর শারীরিকভাবে পুষ্ট শাবক আছে। আরেক সিংহীর শাবক খাদ্যাভাবে ভুগছে, প্রায় মৃত অবস্থা। এমতাবস্থায় প্রথম সিংহী যদি মুমূর্ষু বাচ্চাটিকে খাইয়ে দেয় নিজের বাচ্চার খাবার, তবে-
১) মুমূর্ষু বাচ্চাটির জীবন বেঁচে যাবে। এটা হলো ঐ বাচ্চাটির পাওয়া বেনিফিট তথা benifit received by recipient (b)। যেহেতু একজনের পুরো জীবন বেঁচে যচ্ছে তাই এক্ষেত্রে b=1।
২) সিংহী তার পুষ্ট, সবল বাচ্চার খাবার মুমূর্ষু বাচ্চাটিকে খাইয়েছে। ফলে পুষ্ট বাচ্চাটির ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষতি হবে। এটাকে বলে পরার্থিতা বা সহযোগীতার জন্য মূল্য চুকানো তথা cost of altruism (c)। নিশ্চিতভাবে এক-দুবেলা না খেলে বাচ্চাটা মরে যাবেনা বা বড় কোনো ক্ষতি হবেনা। তাইচ, ধরি c= 0.15।
৩) যেহেতু উভয় একই প্রজাতির তাই তাদের জেনেটিক্যাল মিল আছে স্বাভাবিকভাবেই। ধরি এই জিনগত সম্পর্ক গড়ে (relatedness, r) r= 0.65।
এখন হ্যামিল্টনের সূত্রে আমরা এই মান গুলো বসাই।
0.65×1-0.15>0 বা, 0.5>0 যা সত্য। এভাবে যেসব ক্ষেত্রে b,c এবং r এর বিভিন্ন মানের জন্য হ্যামিল্টনের অসমতা সত্য হবে সেসব ক্ষেত্রে আমরা পরার্থিতা খুঁজে পাবো।
পরার্থিতা বা সহযোগীতার গাণিতিক যুক্তি তো দেখলাম, এবার একটু বিষয়টা অনুধাবন করা যাক। নেচারাল সিকেলশনে ফিট থাকার বা সার্ভাইভ করার উদ্দেশ্যটা কী আসলে? প্রজনন ঘটানো। অর্থাৎ নিজের জিন পরবর্তী বংশধরে প্রবাহ করা যেন প্রজাতির টিকে থাকার সুযোগ বাড়ে। এখন উপরের উদাহরণটাই ভাবেন। নিজের সন্তানের পাশাপাশি আরেকজনের সন্তানকে বাঁচানোর ফলে জিনের প্রবাহ আর প্রজাতির টিকে থাকার সুযোগ অনেকখানি বেড়ে যাচ্ছে। এটাইতো লক্ষ্য। সামগ্রিক ফিটনেস বাড়ানো। এভাবেই পরার্থিতার মাধ্যমে ইনক্লুসিভ ফিটনেস লাভ করা যায়। আর তাই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে প্রতিযেগীতা, দ্বন্দ্ব থাকলেও সার্বিক কল্যাণে সহমর্মিতার উদ্ভব ঘটে।
হ্যামিল্টনের সূত্র থেকে আরও কিছু অনুসিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে।
১) b=0 হওয়ার সুযোগ নেই। কারও উপকার হচ্ছে সহমর্মিতায়। সুতরাং কিছুনা কিছু মান তো থাকবেই b এর।
২) r=0 হবেনা। কারণ একই প্রজাতির প্রাণীদের মাঝে জেনেটিক রিলেশন তো আছেই, সব প্রজাতির জীবের মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্সে কিছু সাদৃশ্য পাবো আমরা।
৩) b এবং r এর মান যেহেতু 0 হবেনা সহমর্মিতায় তাই c এর মান 0 হলে সর্বোচ্চ সহমর্মিতা বা পরার্থিতা দেখা যাবে।
তবে হ্যামিল্টনের সূত্রের হিসাব-নিকাশ অনেক জটিল। আমি শুধু একটা উদাহরণ দিয়েছি, তাও মাত্র একজন গ্রহীতা আর একজন দাতা দিয়ে। পপুলেশন পর্যায়ে হিসাব-নিকাশ করতে কিংবা b, c এর স্টান্ডার্ড মান বের করতে অনেক খাটুনি খাটতে হয় বিজ্ঞানীদের (পড়ুন এটা)। আর পরার্থিতা পুরোপুরি ব্যাখ্যার জন্য গেম থিওরির সহায়তা দরকার। যা হোক, প্রজাতির ভিতরে প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও যে পপুলেশন পর্যায়ে সহমর্মিতা উদ্ভাবিত হয় সেটুকু বুঝার জন্য হ্যামিল্টনের সূত্র পর্যন্ত বুঝলেই হবে। গেম থিওরি কিংবা সেলফিশ জিনতত্ত্ব আনা লাগবে এমন কিছুই এই আর্টিকেলে নিয়ে আসিনি। সেটা ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতন হতো। এবার সরাসরি চলে যাব আমাদের মূল আলোচনায়, কেনো একজন অপরাধীর শাস্তি প্রয়োজন।
অনেক প্রাণীই গোষ্ঠী আকারে বসবাস করে। নীতিটা হলো, "দশে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ।" দশজনের একটা দল, সবাই একসাথে কাজ করে। খাদ্য সংগ্রহ, শিকার, বাসস্থান বানানো, জংলী জানোয়ার থেকে নিজেদের রক্ষা করা, দুর্যোগে টিকে থাকা সব ক্ষেত্রেই সুবিধা পাওয়া যায়। ধরুন, আপনি একা এই কাজগুলো সব করছেন। অপরদিকে দশজনে মিলে করছেন। নিজে চিন্তা করলেই বেনিফিটগুলো বুঝে যাবেন। আর এরকম গোষ্ঠী আকারে বসবাস করা মানুষের প্রথম না এটা আমরা সবাই কমবেশি জানি। তো এই গোষ্ঠীর মধ্যেও আছে ইমপোষ্টার। স্বাভাবিক। সহমর্মিতা্র উদ্ভব ঘটলেও জিনগত প্রতিযোগিতা তো আর গায়েব হয়ে যায়নি তাইনা। ধরুন, দশজনের একজন বেঈমানি করলো। বেশি খাবার পাওয়ার লোভে বা অন্য কোনো সুবিধা পাওয়ার জন্য খাদ্য চুরি, সহযোগীর উপর আক্রমণ বা হত্যাকাণ্ডের মতো কিছু ঘটালো। তাহলে ঐ ইমপোস্টারের উপর গোষ্ঠীর আর কারও ভরসা থাকলো না। এই যে একজনের কর্মকান্ডের জন্য গোষ্ঠীর বাকী সদস্যদের ক্ষতির সম্ভবনা আছে এটা গোষ্ঠীর ফিটনেসের জন্য হুমকি। তাই ঐ ইমপোস্টারকে শাস্তি দিতে হবে। হতে পারে সেটা ঐ ব্যক্তিকে গোষ্ঠীচ্যুত করা বা অন্য কোনো শাস্তি। এই শাস্তির মাধ্যমে গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় অভ্যন্তরীণ শত্রু থেকে, ফলে টিকে থাকার লড়াইয়ে উপযুক্ততা বাড়ে। এরপর আস্তে আস্তে গোষ্ঠীর পরিধি বাড়ে। সূচনা হয় রাস্ট্র, সমাজের। জন্ম হয় সোশ্যাল সাইন্সের।
আমরা সব দেশের অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে যদি চর্চা করি তবে দেখবো মোটাদাগে সব দেশে প্রায় একই ধরনের কর্মকাণ্ডকে অপরাধ ধরা হয়। এত দূরের দূরের দেশ, তবু একই রকম কেনো অপরাধের ধরন? কারণ এই অপরাধ সহজাত, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সরাসরি বা উপজাত হিসেবে উদ্ভুত হয়েছে। এই অপরাধে একজন বা স্বল্প সংখ্যক কিছু মানুষের টিকে থাকার ফিটনেস বাড়ে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড পুরো গোষ্ঠী, রাষ্ট্র বা সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে প্রজাতির একটা বড় অংশের টিকে থাকার উপযুক্ততা কমিয়ে দেয়। তাই ঐ এক-দুজন ব্যক্তিসুবিধার জন্য অপরাধ ঘটালেও বিবর্তনের দৃষ্টিতে অবশ্যই তাদের শাস্তি দিতে হবে। ক্লিয়ার?
আরেকটা বাস্তব উদাহরণ আনি। চিন্তা-ভাবনা আপনিই করবেন। আমি শুধু চিন্তার উপাদানগুলো বলব। ১৯৪৭ সালের আগে ভারত উপমহাদেশ অখন্ড ছিলো। যদি এই উপমহাদেশ অখন্ড থাকতো এবং মানুষে মানুষে ধর্মভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক, জাতভিত্তিক সংঘর্ষ না ঘটতো তবে আমাদের ভারত উপমহাদেশের মানুষদের প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপযোগিতা বা গড় ফিটনেস কেমন হতো? টিপস: তিন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক দিকগুলো নিয়ে গবেষনা করুন। গবেষনাটা চালাতে পারেন পাল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল শুরু আগে অবদি। এরপর ১৯৪৭ থেকে এখন অবদি এই তিন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক অবস্থা পৃথকভাবে গবেষনা করুন। এই দুটো গবেষণার ফলাফল দেখুন। এই গবেষণার সময় ধর্ম, ভাষা, জাত ভিত্তিক দ্বন্দ্ব বাদ দিবেন। নয়তো হিসাব অনেক জটিল হয়ে যাবে। আর আমাদের সেই পূর্বপুরুষ যাদের সময় গোষ্ঠীব্যাবস্থার বা প্রতিযেগিতা থেকে অপরাধ, নৈতিকতার জন্ম হয়েছে তাদের সময়ে এসব দ্বন্দ্ব ছিলো না।
এবার আসি ধর্ষণের ব্যাপারে। উপরের আলোচনা যদি আমরা বুঝে থাকি তবে ধর্ষকের কেনো শাস্তি প্রয়োজন সেটা নিজেই বিবেচনা করে বুঝা যাবে। তবু আমি একটু পিছনের ইতিহাস আবার টানব। আমরা কমবেশি জানি বা দেখেছি যৌন জননের জন্য নিন্ম শ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। এমনকি কাপুচিন মানকি, শিম্পাঞ্জি, পেঙ্গুইনদের মধ্যেও বেশ্যাবৃত্তি বা বহুগামীতা বিষয়টা দেখা যায়। আর পুরুষের বহুগামীতা এখনো মানবসমাজে সরাসরিই বহুল আকারে পাই আমরা। আমাদের প্রাচীন সমাজেও বহুগামিতা ছিলো। তবে সেটা পুরুষদের মধ্যে বেশি, নারীদের মধ্যে তুলনামুলক কম। এর কারনও সহজ- তখন যৌন জননের কারণ যা-ই হোক ফলাফল ছিলো বাচ্চা উৎপাদন, জিনের প্রবাহ বজায় থাকা। একজন মেয়ে বছরে সর্বোচ্চ একবার গর্ভবতী হয়ে বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে। তাই প্রজননের জন্য তার বহু পুরুষের প্রতি আকর্ষণও কম। কিন্তু একজন পুরুষ? সম্ভব হলে বছরে ৩৬৫ দিনে ৩৬৫ জন আলাদা আলাদা নারীর সাথে সহবাস করে প্রজনন ঘটায়। তাই পুরুষের মাঝে বহুগামিতা বেশি, তারা সহজেই যে কোনো সুন্দরী মেয়ের প্রতি আকৃষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং বহুবিবাহ, পরকীয়া তো তাদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। কিন্তু গোষ্ঠী থেকে আস্তে আস্তে একসময় পরিবারের বিষয়টা আসে। কেমন বলি। প্যারেন্টাল কেয়ার অনেক প্রাণীতেই দেখা যায়। নারীর মধ্যে এটা বেশি। এখন একজন পুরুষ কোনো নারীর সাথে সহবাস করে একটা বাচ্চা জন্ম দিলো। ঐ বাচ্চার জিনগত মিল ঐ পুরুষের সাথে বেশি। তাই স্বভাব বশত ঐ বাচ্চার প্রতি ঐ পুরুষের একটা সফট কর্ণার রয়েছে। ঐ বাচ্চার কোনো অসুবিধা হলে, খাদ্যাভাব দেখা দিলে ঐ পুরুষ ছুটে আসতো সহায়তার জন্য। এভাবে পিতা-মাতা-সন্তানের মাঝে একটা ট্রায়াঙ্গল তৈরী হয়। আর পিতা-মাতার মধ্যে সেক্সুয়াল লাভের বিষয়টাতো আছেই। আস্তে আস্তে দেখা গেলো একজন পুরুষের দশজায়গায় দশজন সন্তান। ঐ পুরুষের দশজনের প্রতি সমানভাবে খেয়াল রাখা অসম্ভব বিষয়। ফলে আস্তে আস্তে বহুগামিতা ছেড়ে একগামিতায় ঝোঁকা শুরু করে তারা। পিতা-মাতার সেক্সুয়াল লাভ, সন্তানদের সঠিক পরিচর্যা, যত্নের মাধ্যমে বড় করে প্রজনন উপযোগী করা- এই পদ্ধতির এফিসিয়েন্সি বেশি। তবু একেবারেই বহুগামিতা গেলো না গোষ্ঠী থেকে। বরং একজন পুরুষ তিন-চারজন বা তার বেশি স্ত্রী নিয়ে পরিবার গড়ে তুললো। নারীদেরও অনেক সুবিধা হলো, তারা বাচ্চা সামলাবে নাকি শিকার করবে, নাকি অন্য কাজ গোছাবে? গোষ্ঠী ব্যবস্থায় যদিও এর কিছুটা সমাধান ছিলো, কিন্তু পুরো সমাধানটা ছিলো না। আমি কোনো সেক্সুয়াল সুবিধা পাইনি একটা মেয়ে থেকে, সে আমার গোষ্ঠীর হলেও আমি কেন তার সন্তান এবং তার এত দায়িত্ব নিতে যাবো? বরং আমার নিজেরও অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে, আমি যত্ন নিলে তার নিবো, তার সুরক্ষায় থাকব (এই যে সেক্সুয়াল লাভ, একজনের প্রতি হিংসার মনোভাব আরেকজনের প্রতি ভালোবাসা)। এই বিষয়গুলো আস্তে আস্তে র্যান্ডম গোষ্ঠী ব্যবস্থাকে একটা পরিবার-ভিত্তিক গোষ্ঠীব্যবস্থায় রূপান্তর করতে সক্ষম হলো। আর নিজেই ভেবে দেখুন, নারীদের সুরক্ষা, বাচ্চার সুরক্ষা, পুরুষদের সেক্সুয়াল চাহিদা, সবার খাদ্য চাহিদা, পরবর্তী প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টিকে থাকার মতো যেসব সমস্যা ছিলো তা এই পরিবার ব্যবস্থা আসার ফলে সমাধান হয়ে গেলো।
দিন গেলো, রাত গেলো- পরিবার ব্যবস্থা সুগঠিত হলো। আস্তে আস্তে নারী-পুরুষের একে উপরের প্রতি লয়ালিটি তথা বিশ্বস্ততা বাড়লো। এবার আবার অতীতে ফিরি, আরও অতীতে, যখন সেক্সের উপর ভিত্তি করে ভালোবাসার উৎপত্তি হয়নি। কিন্তু উৎপত্তি ঘটেছে ধর্ষণের। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন, ধর্ষণের। ধর্ষণ অনেক আগেই প্রকৃতিতে এসেছে। কেনো এসেছে? কারণ, সন্তান উৎপন্ন হলেই হলো, সেটা নারীর অনুমতিতে হোক বা না হোক, জিনের প্রবাহ তো ঘটে। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু... এটায় বড় একটা কমতি রয়েছে। প্রকৃতিতে টিকে থাকার নীতিটা কী ছিলো? ফিট ইনাফ টু সার্ভাইভ আপটু ব্রিডিং। মেটিংয়ের জন্য একজন পুরুষ তার সামর্থ্য প্রমাণ করে নারীর সামনে, নারী যদি ওই পুরুষের শক্তি, সামর্থ্য দেখে মুগ্ধ হয় তবে সে রাজী হয় মেটিংয়ে। ফলে যেটা হয়, সুস্থ সবল জিন যেটাকে অভিহিত করা যায় গুড জিন হিসেবে সেটাই পরবর্তী বংশে অতিবাহিত হয়। কিন্তু ধর্ষণে নারীর সন্মতি নেওয়া হয়না যার ফলে পরবর্তী প্রজন্ম অপেক্ষাকৃত লোয়ার কোয়ালিটির সন্তান জন্ম নিবে। এর ফলাফল হিসেবে ঐ প্রজাতির টিকে থাকার উপযুক্ততা তথা ফিটনেস কমে যাবে। এর বাস্তব প্রমাণও আছে। টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যেসব সন্তান নারীর সন্মতিতে হওয়া প্রজননের মাধ্যমে ঘটে সেটার সার্ভাইভাল রেট বেশি আর যেমনটা আগে বলেছি, সন্মতি ছাড়া হওয়া প্রজননে সার্ভাইভাল রেট কম। এছাড়া ধর্ষণের ফলে নারীর শরীরে নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। তাদের জেনেটিলিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা পরবর্তীতে তাদের যৌন জননের উপর প্রভাব ফেলে। ধর্ষণের সময় অনেকক্ষেত্রে পুরুষ এতোটা হিংস্র হয়ে ওঠে যে সে নারী প্রাণীর সাথে থাকা সন্তানদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না, এই হিংস্রতা প্রজাতীর টিকে থাকার পথে অনেক বড় বাঁধা তৈরি করে। তাহলে বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ চরম ক্ষতিকর এবং প্রতিবন্ধক কোনো প্রজাতির সামগ্রিকভাবে টিকে থাকার জন্য যদিও এটা বিবর্তনেরই উপজাত।
আমরা এবার ফিরে আসব আমাদের মানবসমাজে। একটা জিনিস চিন্তা করুন তো। একজন ধর্ষকের বোন বা প্রেমিকা ধর্ষিত হলে তার কেমন বোধ হবে? হ্যাঁ, তারও ঠিক ততটাই রাগ, দুঃখ, কষ্ট হবে। ধর্ষণের পিছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ কীভাবে কাজ করে তাতো জানলাম, এবার জানুন পরিচিত কেউ বা অপরিচিত কারও ধর্ষনের কথা শুনলে কেনো কষ্ট হয়। এই অনুভূতিটা আমাদের মাঝে দৃঢ় হয়েছে পরিবার ব্যবস্থা এসে। ঐ যে স্ত্রীর প্রতি সেক্সুয়াল লাভ, দায়িত্ববোধ, বোনের প্রতি ভালোবাসা, বান্ধবীদের প্রতি কেয়ারিং, সামাজিক দায়িত্ব। এসবই আমাদের মাঝে তীব্র করেছে ধর্ষণবিরোধী চেতনা। নারীর অনুমতি ছাড়া জোর করে তাদের সাথে সহবাস হয়ে উঠেছে গোষ্ঠীর মধ্যে শৃঙ্খলাহীনতার, পরিবার-পরিবার কিংবা কিংবা ব্যাক্তি-ব্যাক্তির সংঘর্ষের কারণ। সাথে সাথে ধর্ষিতার মানসিক ও শারিরীক স্বাস্থ্যের অবনতি তো আছেই। আর তাই ধর্ষণ বিবেচিত হওয়া শুরু হয়েছে অপরাধ হিসেবে। হয়তো একসময় এই অনুভূতি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এত দৃঢ় হবে যে বিবর্তনের পথে বাঁধা এই বিবর্তনেরই সন্তান "ধর্ষণ" মানবসমাজ বা মানব পরবর্তী প্রজাতি গুলো থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এবার আসি উপসংহারে। ধর্ষককে কেন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শাস্তি দিতে হবে? কারণটা আগেই বলেছি। যে কারণে কোনো গোষ্ঠী থেকে একজন ইমপোস্টারকে বিতাড়িত করা হতো বা শাস্তি দেওয়া হতো। হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন। গোষ্ঠীর তথা প্রজাতির টিকে থাকার উপযুক্ততার (ফিটনেস) জন্য হুমকি। তাই শাস্তি দেওয়া বাঞ্চনীয়। এখানে ব্যক্তির ফ্রি উইল বা স্বাধীন চেতনা থাকলেও প্রজাতির ফিটনেসের গুরুত্ব বিবর্তনে অনেক বেশি।
আশা করি যিনি এই প্রশ্নের উদ্ভাবক তিনি তার উত্তর পেয়ে গেছেন। যেতে যেতে পথে আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে যাই। যদি হঠাৎ করে কোনো রাষ্ট্রের সব আইন বাতিল হয়ে যায়, তবে ঐ রাষ্ট্রের সদস্যদের অবস্থা কেমন হবে ভবিষ্যতে? বিবর্তন বা নেচারাল সাইন্স দিয়ে ব্যাখা ভাবুন। ধন্যবাদ।
যে যে বই পড়বেন:
১) ভালোবাসা কারে কয়, অভিজিৎ রায়।
২) Our inner ape, Frans De Waal
৩) The origin of virtue, Matt Ridley
আর কোনো বই না। এই তিনটা
srijon publisher