Answered 2 years ago
শেষ বইটা পড়া নয়, শোনা 🎧 । তবে আশা করছি পাঠককুলের তাতে খুব একটা আপত্তি হবে না উত্তরটা পড়তে ।
বইটার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আগের একটা উত্তরে সংক্ষেপে লিখেছি । উত্তরের মন্তব্যে অনেক লোকজন পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাই তাঁদের আগ্রহটা একটু উস্কে দিতেই মূলত এই উত্তরটা লিখতে বসেছি ।
অডিওবুক শোনা এই বছরই প্রথম শুরু করেছি । প্রথম যেটা শুনে শেষ করেছি সেটা হল মার্ক ম্যানসনের তুমুল জনপ্রিয় বই "The Subtle Art of Not Giving a F*ck"; এখানে অনেকের কাছে সুখ্যাতি শুনে এবং লেখকের নিজেরই বানানো বইটির সংক্ষিপ্তসার ভিডিও দেখে উৎসাহিত হই বইটির ব্যাপারে ।
তবে এই বই নিয়ে আমি এখানে লিখতে বসিনি । এটা নিয়ে আলোচনা কোরা বাংলায় ইতিমধ্যেই অনেক হয়ে গিয়েছে । না, আমি লিখতে বসেছি লেখকের দ্বিতীয় বই "Everything is F*cked: A Book About Hope" বইটি নিয়ে । এই বইটিও অডিওবুকে শুনেছি এবং এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শুনে শেষ করতে চলেছি ।
ছবিসূত্র: Goodreads
বইটি যদিও সেল্ফ-হেল্প ক্যাটেগরির, এটা আর পাঁচটা সেল্ফ-হেল্প বইয়ের মত হালকা চালে পড়ার বই একেবারেই নয় । বলতে গেলে এত দার্শনিক আলোচনা আর বিশ্লেষণসমৃদ্ধ বই এই ক্যাটেগরিতে আমি আগে দেখিনি । অন্য সেল্ফ-হেল্প বইগুলোকে যদি হাসিখুশি স্বভাবের বহির্মুখী মানুষ বলে কল্পনা করেন তবে এই বইটি হলো গভীর চিন্তায় মগ্ন, বিষণ্ণ প্রকৃতির একজন অন্তর্মুখী মানুষ । পাঠককুল এবার নিজেই বুঝে নিন ।
না, চিন্তা নেই, উত্তর আমি এখানে শেষ করছি না, বরং সবে শুরু । বইটি কী নিয়ে তার একটা প্রাথমিক ধারণা বইয়ের শিরোনাম থেকেই পাওয়া যাচ্ছে— বইটি "আশা" নিয়ে ।
আশা ব্যাপারটাকে আমরা সবাই ইতিবাচক ভাবে দেখতেই অভ্যস্ত; কথাতেই বলে, আশায় বাঁচে চাষা । আসলে শুধু চাষা নয়, আমরা সবাই আশাতেই বাঁচি । বলতে গেলে আমরা যেন-তেন-প্রকারণে নিজেদের আশা দিতে প্রস্তুত কারণ নইলে আমরা মুখোমুখি হই এমন এক দর্শনের যা আমাদের কাছে ভয়াবহ— নাস্তিবাদ (nihilism) । একজন নাস্তিবাদী মানুষের মন হলো আশাহীনতার এক ধূসর উপত্যকা যেখানে আনন্দও নেই, বিষণ্ণতাও নেই ( অন্তত আমাদের ধারণা তাই) ।
মানুষকে আশা দিতে সৃষ্টি হয়েছে ধর্ম— কেবল ঐশ্বরিক ধর্মই নয়, সেইসাথে মতবাদভিত্তিক ধর্ম (পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ, নারীবাদ, প্রমুখ) এবং আন্তঃব্যক্তিক ধর্ম ( পরিবারতন্ত্র, প্রেম, ভালোবাসা, ভক্তি, শিষ্যত্ব, ইত্যাদি ) । এই সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে মানুষ আশা খোঁজে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের ।
সভ্যতার আদিতে মানুষের জীবনধারণ এতটাই কঠিন ছিল যে মানবজাতি পৃথিবীর বাইরে কোনো এক কাল্পনিক দুনিয়ায় মৃত্যুর পরে সুখে বসবাসের স্বপ্ন দেখতো । সৃষ্টি হয়েছিল স্বর্গ ও নরকের ধারণা । ভালো কাজের মাধ্যমে স্বর্গলাভের আশায় মানুষ নিজের জীবনকে উদ্দেশ্য প্রদান করতো এবং নরকগমনের ভীতির মাধ্যমে একে-অন্যকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করতো ।
এক সময় আবির্ভাব ঘটলো বিজ্ঞানের এবং মানুষের জীবনে নিয়ে এলো বিপ্লব । বিজ্ঞানের হাত ধরে মানুষ প্রথমবারের মতো দুর্ভিক্ষ ও মহামারী জয় করে উন্নতমানের জীবনযাপনের সুযোগ তৈরী করলো । তাঁর জীবন সংকটমুক্ত হওয়া আরম্ভ হলো (হ্যাঁ, বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ মারণাস্ত্রও তৈরী করেছে অনেক, কিন্তু বিজ্ঞানের নিট অবদান যে ইতিবাচক সেটা অস্বীকার করা চলে না )। ক্রমে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির হাত ধরে আমরা আজ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে আমাদের জীবনে সংকট কম, স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বেশি ।
কিন্তু এই বাহ্যিক সংকটমুক্ত জীবনে আজ দেখা দিয়েছে এক অন্য সংকট । সভ্য, উন্নত দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে মানুষ বড়মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে বিষণ্ণতায় ও অবসাদে । অনেকে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো চরম পথ । কিন্তু কেন?
কারণ বাহ্যিক সংকট না থাকাতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকটে— আশাহীনতার সংকট । যার জীবনে যত বেশি সুখস্বাচ্ছন্দ্য, তার জীবনে তত বড় এই সংকট— জীবনকে কীভাবে অর্থপূর্ণ করে তুলবো?
বইতে এটাকে বলা হয়েছে "প্যারাডক্স অফ প্রগ্রেস"— যে জীবনের মান যত উন্নত, সে জীবন তত বেশি অর্থহীনতায় আক্রান্ত । যে জীবনে সংগ্রাম নেই, সে জীবন তত অন্তঃসারশূন্য ।
আর এখান থেকেই উঠে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি— মানুষের মনে আশা থাকতে হলে তাঁর জীবনে সংকট থাকা দরকার । সংকটবিহীন জীবন এক আশাহীন জীবন । কিন্তু এই আশারও রয়েছে এক ভয়াবহ রূপ— যে আশা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, সেই একই আশা মানুষকে দাঙ্গা, রক্তপাত, হানাহানিতেও উদ্বুদ্ধ করে । সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় বুঁদ মানুষ যে চরম অমানবিক কাজ করতেও দ্বিধা করে না তার সাক্ষ্য মানবজাতির ইতিহাসই বহন করছে ।
তাহলে কী দাঁড়ালো? একদিকে আশাপূর্ণ জীবন সংঘাতপূর্ণ, অন্যদিকে সংঘাতহীন জীবন আশাহীন । একদিকে হিংসা, অন্যদিকে নাস্তিবাদ । এই শাঁখের করাতের হাত থেকে কি মানবজাতির উদ্ধার নেই?
বাকিটা আর বলবো না, কারণ পাঠককে বই পড়তে উৎসাহ দিতেই এটা লেখা । সুখের আশা না করেও মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারে কিনা তাঁরই উত্তর সন্ধান করেছেন লেখক বইটিতে এবং দ্বারস্থ হয়েছেন দর্শনের । আর সেই প্রয়াসে তুলে এনেছেন এমন কিছু মণিমাণিক্য যা যে কোনো চিন্তাশীল পাঠককে উদ্দীপ্ত করবে বলেই আমার বিশ্বাস । 📖
dilipkumar publisher