আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc^2 অনুযায়ী ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। কিন্তু আমরা আমাদের চারপাশে সকল বস্তুর ভরকে কেন শক্তিতে রূপান্তর করতে পারি না?
0
0
1 Answers
11.6 K
0
Answered
1 year ago
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে শুরু থেকেই ভাবা হতো পদার্থ ও শক্তি দুটি ভিন্ন সত্ত্বা,কিন্তু E=mc^2 সেটা বদলে দেয়,এই সূত্রের E=Energy আর m=Mass,সুতরাং Mass বা ভর থেকে শক্তি উৎপাদন সম্ভব আর Energy থেকে ভর উৎপাদন সম্ভব।
চলুন একটু পিছনে যাওয়া যাক।
নিউটনের বলবিদ্যা আবিষ্কারের প্রায় ৩৫০ বছর পেরিয়ে গেছে।এই ৩৫০ বছরে উদ্ভুত সকল পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যার সমাধান করেছে নিউটনের বলবিদ্যার সূত্র,বা এই সূত্রের Derivation থেকে পাওয়া অন্যান্য সূত্র।৩৫০ বছরে পদার্থবিদদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিলো পদার্থবিদ্যার সকল কিছু আবিষ্কার করা হয়ে গেসে,নতুন আর কিছু আবিষ্কার হবে না।
তখন এক প্রতিভাবান ছাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে পদার্থবিদ্যা পড়তে চাইলে তার শিক্ষক তাকে বলেন,পদার্থবিদ্যায় আর নতুন কিছু আবিষ্কার হবে না,তুমি অন্য বিষয় পড়ো।কিন্তু সেই শিক্ষার্থী পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হয়ে পদার্থবিদ্যার সম্পূর্ণ নতুন এক শাখার জন্ম দেন,তার নাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স,আর ছাত্রটির নাম ম্যাক্স প্লাংক।
অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বুধ গ্রহের উপগ্রহের আবর্তনের হিসাব মিলাতে পারছেন না নিউটনের সূত্র দিয়ে।কিন্তু নিউটনের সূত্র তো ভুল হওয়া সম্ভব না,তাই তারা ব্যাখ্যা করেন সৌরজগতের আরো অনাবিষ্কৃত গ্রহ আছে,এদের ভর যুক্ত করলে বুধের উপগ্রহের আবর্তনের সঠিক হিসাব পাওয়া সম্ভব,এই গ্রহ দুইটার নাম তারা দেন ভালকান ও এক্স।এই ভালকান ও এক্স নিয়ে সৌরজগতের মোট গ্রহের সংখ্যা হয় ১১টি।কিন্তু টেলিস্কোপে এই গ্রহ দুইটার সন্ধান পাওয়া যায় না।তাদের ধারণা ভবিষ্যতে এ গ্রহ দুইটি আবিষ্কার হবে।(পর্যায়সারণীর মৌলের মতো)
মজার বিষয় আমি ছোটবেলায় পড়েছিলাম সৌরজগতে গ্রহ ১১টি,যার মধ্যে ভালকান ও এক্স আছে।পরবর্তীতে বড় হয়ে দেখি,সৌরজগতে গ্রহ ৯টি।আমার মনে প্রশ্ন ছিলো,বাকি দুইটা গ্রহ গেলো কই?পরে আশপাশ থেকে শুনলাম দুইটা গ্রহ নাকি পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে ধ্বংস হয়ে গেসে🤣🤣🤣।
কিন্তু বাস্তবে ভালকান ও এক্সের অস্তিত্ব নেই,এই বিষয় বেশ পড়ে জানতে পেরেছি।
মূলত নিউটনীয় পদার্থবিদ্যায় স্থান ও কাল পরম।কিন্তু নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা ১৯-২০ শতকে এসে বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হচ্ছিলো।আবার,নিউটনের সূত্রগুলো অতিক্ষুদ্র ও দ্রুতগামী কণার গতিকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।
তখন এক অফিসের কেরাণী দাবি করে বসে নিউটনের সূত্র নাকি ভুল,স্থান ও কাল পরম নয়,অভিকর্ষ বল স্থান কালের বক্রতার জন্য সৃষ্ট।
তিনি আর কেউ নন,আমাদের আলবার্ট আইন্সটাইন,তার থিউরি অফ রিলেটিভিটি থেকেই আসে E=mc^2 সূত্রটি।
এই E=mc^2 এর সূত্র ধরেই শুরু হয় পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করে বোমা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা।জার্মান বংশদ্ভূত আমেরিকান ইহুদি পদার্থবিদ Oppenheimer তার বিখ্যাত Manhattan প্রজেক্টে সফলভাবে নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণে সমর্থ হন।এর উপরেই নির্মিত ক্রিস্টোফার নোলানের মুভি Oppenheimer.
মূলত নিউক্লিয়া বোমা তৈরি হয় নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি নিউক্লিয়ার ফিশন থেকে।
একটি গতিশীল নিউক্লিয়াসকে দিয়ে আঘাত করা হয় Uranium 235 আইসোটোপকে।
এই আঘাতে Uranium 235 ভেঙে Ba ও Kr এ পরিণত হয় এবং ৩টি নিউট্রন নিক্ষেপ করে।এই ৩ টি নিউট্রন আরো ৩টি Uranium 235 কে ভেঙে আবার Ba এবং Kr এ পরিণত করে এবং ৯টি নিউট্রন নিক্ষেপ করে।
এই ৯টি নিউট্রন আরো ৯টি Uranium 235 কে ভেঙে আবার Ba এবং Kr এ পরিণত করে এবং ২৭টি নিউট্রন নিক্ষেপ করে।
এভাবে একটি চেইন বিক্রিয়া সৃষ্ট হয়,যা অবিরাম চলতেই থাকে।
এই বিক্রিয়ায় U-235 এর ভরের খুব ক্ষুদ্র অংশ পদার্থ থেকে শক্তিতে পরিণত হয়।কিন্তু এই ক্ষুদ্র ভর যখন আলোর গতির বর্গ দিয়ে গুণ হয়(mc^2),তখন এই অল্প ভর থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব(E=mc^2).
১৯৩০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী Hans Bethe আবিষ্কার করেন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়াই সূর্যের শক্তির উৎস।
জার্মান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী Otto Hahn (1879 – 1968) নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া আবিষ্কার করেন।ডিসেম্বর ১৯৩৮ এ Otto Hahn ও Lise Meitner ও Fritz Strassmann বার্লিনের ল্যাবরেটরিতে নিউক্লিয়ার ফিউশান আবিষ্কার করেন।
জার্মান আমেরিকান Enrico Fermi প্রথম চেইন বিক্রিয়া সফলভাবে ঘটাতে সক্ষম হন।
মজার বিষয় Enrico Fermi,হাইড্রোজেন বোমার জনক Edward Teller এরা মূলত জার্মান থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি।জার্মানিরাই প্রথম নিউক্লিয়ার ফিশন,ফিউশন বিক্রিয়া আবিষ্কার করে।আমেরিকা ছিলো এক্ষেত্রে যোজন যোজন পিছিয়ে,এমনকি আমেরিকায় নিউক্লিয়ার প্রোজেক্টে কাজ করা বিজ্ঞানীরা মূলত জার্মান থেকে পালিয়া আসা ইহুদি।তাই আমেরিকা যখন জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলে,জার্মান বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসই করতে পারেনি আমেরিকা পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করেছে।
ধারণা করা হয়,হাইজেনবার্গ পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রজেক্টে নিয়োজিত ছিলেন জার্মানের পক্ষে।যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিটলার জিততো তাহলে নোলান হয়তোবা হাইজেনবার্গকে নিয়ে সিনেমা বানাতেন।
কেন সকল বস্তুর ভরকে শক্তিতে রূপান্তর অসম্ভব?
পদার্থ থেকে শক্তি তৈরি জন্য বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে চেইন বিক্রিয়া।যেসব মৌল চেইন বিক্রিয়া দেয় তাদেরকে নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা হয়।যেহুতু চেইন বিক্রিয়া শুধুমাত্র কিছু ভারী মৌলই দেয়,সেহুতু,আমাদের চারপাশের সকল বস্তুর ভরকে শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব নয়।
এমনকি প্রকৃতিতে পাওয়া অধিকাংশ ইউরেনিয়াম মূলত U-238,কিন্তু U-238 চেইন বিক্রিয়া দেয় না,তাই U-238 কে দিয়ে পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব নয়।U-238 কে গ্যাস ফিউশন আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে U-235 এ রূপান্তর করে U-235 কে দিয়ে চেইন বিক্রিয়া ঘটানো হয়।
U-235 ছাড়া প্লুটোনিয়াম দিয়েও নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়া সম্ভব(প্লুটোনিয়াম U-235 থেকেও ভালো চেইন বিক্রিয়া দেয়),তবে প্লুটোনিয়ামও প্রকৃতি পাওয়া যায় না,U-238 কে ভেঙে বানাতে হয়।Oppenheimer এর Manhattan প্রজেক্টের জন্য মাত্র ২ গ্রাম প্লুটোনিয়াম প্রস্তুত করা হয়েছিলো।
যাবার আগে নোবেল পুরস্কার জয়ের শর্টকাট বলে যাই,বিজ্ঞানীরা পদার্থ থেকে শক্তি উৎপাদনে সম্ভব হলেও,শক্তি থেকে পদার্থ উৎপাদন এখনো সম্ভব হয়নি।আপনি যদি বিদ্যুৎ থেকে এক অনু হাইড্রোজেন বানাতে পারেন তবে নোবেল নিশ্চিত।
#অভ্র আহমেদ
tithikhatun publisher