Answered 3 years ago
অজ্ঞাতনামা যতগুলো প্রশ্ন এবং উত্তর আছে তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ বিদ্বেষ ও বিতর্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যেই করা হয়। কয়েকদিন আগে অসমী সিনেমা আমিষ দেখলাম, এই সিনেমাতে খুব দারুণ কিছু ব্যাপার আছে, দারুন কিছু চিন্তা আছে। শিল্পের বিচারে কারো কাছে এই সিনেমা ভালো লাগে কারো কাছে বাজে লাগবে।
ছবিঃ বিডিনিউজ২৪
সিনেমাতেই একটা দৃশ্যে খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এই ব্যাপারটা যদিও সেটা মাংসের স্বাদ আস্বাদনের সাথে সম্পর্কিত- পছন্দ বা অপছন্দের কোন ইউনিভার্সাল ডেফিনেশন হয়না।
প্রশ্ন যেই করে থাকুন, এই ব্যাপারটা আপনার মাথাতে গেঁথে নিন। আপনি হুমায়ুন আহমেদ কে চতুর্থ শ্রেনীর সাহিত্যিক ভাবলেও হাজারো পাঠকের কাছে হুমায়ুন আহমেদ জীবনবোধের অন্য রুপ। এই হিমু সিরিজের কথায় ধরেন না কেন, হিমুর যাপিত জীবনে কোন না পাওয়ার আফসোস নেই, হারানোর ভয় নেই, লোভ লালসা নেই; থাকার ভেতর আছে একটুকরো রুপা-নীল জোছনা। জোছনা রাতে দুর থেকে দাড়িয়ে নীল শাড়ি পরিহিতা প্রিয়জনকে একঝলক দেখার ভেতরে যেই নির্মোহ প্রেম থাকে সেই প্রেমবোধ সবাই বুঝবে না।
কালো এবং অসুন্দর মেয়েদের জেদ কখনো থাকেনা, এদের জীবন কাটাতে হয় একাকী- এ এক অসাধারণ জীবনবোধ, এই বোধ বোঝার জন্য তেমন জীবন থাকতে হয়। নিষাদ উপন্যাস মিসির আলী নিজেকে নিয়ে ভেবেছিলেন এভাবে- ‘অদ্ভুত মানবজীবন। মানুষকে আমৃত্যু দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে বাস করতে হয়…"। দুজন মানুষ আক্ষেপ করছে ঈদ এমন এক সময় এসেছে যখন বাসা ভাড়া, ইউটিলিটি বিল সব একসাথে। এসব বিল-বাট্টা দিতে দিতে তাদের একজনের পকেট গড়ের মাঠের কাছাকাছি- ভাইরে খুব প্যারায় আছি, এমন সময় ঈদ আইলো, এ খরচ সে খরচ দিতে দিতে হাতে কিছুই থাকলো না। অপরজনের উত্তর- প্যারা ছাড়া জীবন বলতে কিছু আছে? যতদিন বাঁচবা এই প্যারার সাথেই বাঁচতে হবে।
বোঝার জন্য আমাদের একটা মাথা দরকার, একজন হুমায়ুন আহমেদ সেটাই বলে গিয়েছেন যেটা আর-দশটা মধ্যবিত্ত মানুষের মুখ থেকে আক্ষেপ, অনুযোগ বা আনন্দ হয়ে বের হয়। হুমায়ুন আহমেদ শুধু সেখানে শিল্প দিয়ে সাজসজ্জা করেছেন। এই ব্যাপারটা বোঝা হয়ে গেলে, এই ব্যাপারে দক্ষ হয়ে গেলে পাঠককে আটকে রাখা যায়।
বৃহন্নলা উপন্যাসে হুমায়ুন আহমেদের সাথে মিসির আলী দেখা হয়েছিল একবার। হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে মিসির আলী নোট করেছিলেন- নাম: হুমায়ুন আহমেদ, বিবাহিত, তিন কন্যার জনক, পেশা অধ্যাপনা, বদমেজাজি, অহংকারী। অধ্যাপকদের যেটা বড় ত্রুটি, অন্যদের বুদ্ধিমত্তা খাটো করে দেখা, ভদ্রলোকের তা আছে।’
মিসির আলীর বয়ানে হুমায়ুন আহমেদ নিজের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন যেটা নিয়ে তিনি হয়ত ব্যক্তিজীবনে অনুতপ্ত হতেন। নিজের অন্ধকার বা আবছা আলোকিত দোষগুলো এভাবে তুলে ধরতে অন্যরকম সাহস লাগে।
সাহিত্য দুই কারণে পড়া যায়- উপভোগ করার জন্য এবং নিজের সংকীর্ণতা চিহ্নিত করার জন্য। প্রথম কারণে যদি কেউ সাহিত্য পড়ে তাহলে সাহিত্যের রস পুরোপুরি আস্বাদন করা যায় না। সাহিত্যের রস জিহ্বার স্বাদ না, হৃদয়ের স্বাদ। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে হয় অন্তরের অনুভূতি দিয়ে।
আমার কেবলমাত্র আছে একাকিত্ব। এই একাকিত্ব আমাকে রক্ষা করে! (এ্যালোন ইজ হোয়াট আই হ্যাভ, এ্যালোন প্রটেক্ট মি!- শার্লক হোমস)। মহাবিশ্বে আমাদের সাথে আত্মীয়তা করার মত হয়ত অনেকেই আছে, তবুই দিনশেষ আপনি আমি সবাই একা। এই একাকিত্ব আমাদের হাসতে শেখায়, বাঁচতে শেখায়, জীবনবোধ শেখায়। হুমায়ুন আহমেদ তেমনি একজন ছিলেন, আত্মার একাকিত্বকে তিনি হয়ত জয় করে নিয়েছিলেন, বিজিত একজন মানুষ তার সরস বা কখনো বিরস জীবনবোধকে কলমের খোঁচায় জীবন্ত করেছেন। লিখতে সবাই পারে, লেখায় জীবন দিতে পারে কজনা? যেকজন পারে তাদেরকে সাহিত্যিক বলা হয়, তাদের কেউ বঙ্কিম, কেউ শরৎ কেউ হুমায়ুন। সাহিত্যে কোন শ্রেনী বিভাজন থাকেনা, সাহিত্যিকদের মাঝেও কোন বিভাজন থাকেনা, যেটা থাকে সেটা জীবনবোধের ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট, ভিন্ন উপস্থাপন আর ভিন্ন বোধ। সবজায়গাতে যেটা থাকে সেটা জীবন।
পছন্দ-অপছন্দের কোন ইউনিভার্সাল ডেফিনেশন নেই, অতএব হুমায়ুন আহমেদ আপনার কাছে ওভাররেটেড হতে পারে। তাই বলে তো আর তাকে শ্রেনীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের মত শ্রেনীকরণ করে ফেলা কাম্য নয়।
শ্রীনিত্যানন্দের সেই উক্তিখানা আপনার জন্য- "মেরেছে কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দিব না!" মানুষে মানুষে এই প্রেম দেয়া নেয়া বজায় রাখুন, মানব প্রেমে সমাজ সংস্কার হয়।
Himel Ahmed publisher