Answered 3 years ago
তারিফ আহনাফ সাহেব এর সম্মানে নতুন করে লেখাঃ (১৩ এপ্রিল ২০২০)
কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেন না বলে রাজনীতিবিদরা ভবিষ্যত উত্তরসুরীদেরকে ক্রমে গড়ে তুলেন এমন একটা আশা অনেকেই করেন। যত প্রিয় আর শ্রদ্ধেয়ই হোন, একদিন তো দুনিয়ার ভার পরের প্রজন্মের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। কেউ জানেনা সেই শুন্যস্থানে কে আসবেন, আর দেশের মঙ্গলের ও সুরক্ষার কাজ কতখানি করবেন।
ভারত এসে বাংলাদেশকে দখল করে নেবে কিনা তার উত্তর দিতে গেলে ইতিহাসের ক্রম বিবর্তনের একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার।
১। শিল্পবিপ্লবের আগের যুগে (১৭৫০ সালের আগে) প্রায় দশ হাজার বছর ধরে দুনিয়াতে চলেছে কৃষি। মোট উৎপাদনের ৯০% ভাগেরও বেশি এসেছে জমি থেকে। অকৃষি যেটুকু ছিলো, সেটাও কৃষির ঘাড়ে চেপে বসা শাসক ও সেনাদলের বিশেষ প্রয়োজন পূরণের জন্য কিছু কুটির শিল্প আর সেবা মানে তো শাসন, বিচার, দমন, কিছু শিক্ষা ও গবেষণা। সেকালে গায়ের জোরে জমি দখল করাই ছিল বীরের কাজঃ কে কত খুন-জখম-দখলদারি করতে পেরেছে সেই ছিলো তার মহিমার মাপকাঠি।
বাংলাদেশ এখন যে ভূমি নিয়ে গঠিত, সেখানে ছিল নানা রাজ্য, অঙ্গ-বঙ্গ- পুন্ড্র-রাঢ়-সমতট ইত্যাদি। সে সব রাজ্যের রাজারা একজন আরেকজনের দেশ দখল করতেন। যুদ্ধবিগ্রহ ছিলো নিয়মিত নিত্যদিনের ঘটনা। বাইরে থেকে বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রায় বিরতিহীন ভাবে চলেছে আগ্রাসী আক্রমণ। দিল্লীর শাসক বাংলাদেশে বারেবারে হানা দিয়েছে, অনেক সময় বাংলা ছিল দিল্লী অথবা অন্য কোন অঞ্চলের আগ্রাসী শাসক ও সেনাদের দখলে। কিন্তু বাঙ্গাল বলে কথাঃ বারেবারেই বাঙ্গালরা বিদেশী ও দেশী প্রভুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আর বাংলার লোক আশেপাশে কাছে ও দূরে প্রভুত্বও করেছে মাঝে মাঝেই। বাঙ্গালীরা উত্তরে, পূর্বে ও পশ্চিমে আগ্রাসন করে দখল করেছে পরের জায়গা পরের জমি, আর দক্ষিণের সাগর পাড়ি দিয়ে ছড়িয়ে গেছে দিকে-দিগন্তে। সিংহলে, কম্বোজে, রাখাইনে, বালিতে-মালয়ে বাঙ্গালী গিয়ে মিশে গেছে অইখানের মাটিতেই।
২। শিল্পবিপ্লব এসে সব হিসাব দিল ভন্ডুল করে। যে কৃষি থেকে এককালে আয়ের ৯০% ভাগের বেশী আসতো, সেই কৃষি পড়ে রইল পেছনে, শিল্প সামনে এসে ক্রমে দখল করে নিলো আয়ের সিংহভাগ। আগে অস্ত্রধারী দস্যুর দল কৃষির আয় কুক্ষিগত করে রাজাবাদশা প্রভুদল হয়ে ভোগবিলাসের সামগ্রী পেত, সাধারণ লোকের কপালে জুটেছে অতি সামান্য। কিন্তু শিল্পবিপ্লব এসে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিল সম্পদ, যা লুট দিয়ে নয়, উৎপাদন আর বাণিজ্য দিয়ে অর্জিত। এই আয় এসেছে শিল্প ও শিল্প-সন্নিহিত সেবা থেকে। এতে জমির অবদান প্রায় শুন্য। তার মানে, এখন আয় বাড়াতে চাইলে জমি দিয়ে আর কিছু হবে না, দরকার হল শিল্প কিংবা বাণিজ্য। জমি ছাড়, গ্রাম থেকে পালাও, শহরে গিয়ে কারখানায় বা দোকানে অফিসে কাজ করে রুজি কর, ভুলেও যেওনা অই মাটির করুণ কারাগারে। ধূলায় পড়ে কাদায় পড়ে কচু উৎপাদন করে মিলবেনা আর তেমন কিছু।
৩। জমি নয়, শিল্প ও বাণিজ্য থেকেই আয়। এই নিয়েই শুরু হল এক নতুন যুগ। কৃষির মন-মানসিকতা নিয়ে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশ গুলি এশিয়া, আফ্রিকা, আর আমেরিকায় গড়ে তুলল কলোনী। এই হল এক নতুন ধরণের দখলদারীঃ আগে দিল্লীর শাসক বাংলা দখল করলে বাংলার মালিক হয়ে সেখানেই বাঁচবে-মরবে থাকবে -খাবে, চিরদিন খাজানা নেবে শাসন করবে এমন চিন্তা করেছে, বাংলাকে কলোনী হিসাবে দেখেনি, দেখেছে নিজের দেশ হিসাবে। উত্তর প্রদেশ মধ্য প্রদেশ বিহার উড়িষ্যা, মগধ মালাবার থেকে আসা লোক বাংলায় এসে বাঙ্গালী হয়ে গেছে, শক-হুন-পাঠান -মোঘল-তুর্কি-আফগানী সব বাঙ্গালী হয়ে গেছে। বাংলা তাদের কলোনী ছিলো না, ছিলো তাদের বাড়ী, তাদের ঘর, তাদের আবাসের নতুন ভুমি। আর কলোনী হল পরের বাড়ী, দখলে আছে, কিন্তু শিল্পের কাঁচামালের উৎস হিসাবে, পণ্যের বাজার হিসাবে।
একটা সময় ছিল যখন গ্রামের লোক চরে গিয়ে বেড়াহীন একটা চালা বানিয়েছে, অর অইটার নাম খোলা বা খলাঃ কয়দিন ধান তুলেছে দিনে রাতে, থেকেছে অই সাময়িক খোলায়, তারপর ফিরে গেছে নিজের স্থায়ী বাড়িতে, সাথে নিয়ে গেছে চরের ধান আর শুটকি হয়ে যাওয়া মাছের সাথে কিছু তাজা মাছ। চরকে ঘর করেনি, রেখেছে পর করে। কলোনী হল সেই চর, ঘর নয়।
৪। এই জিনিসটা ভাল করে বুঝা দরকার। আগের যুগের বীরপুরুষ পরের ঘরের মেয়েকে কিডন্যাপ করে ঘরে এনে বিবি বা উপপত্নী বানিয়েছে, আ[পন করে নিয়েছে। কিন্তু পরের যুগে সেই মেয়েকেই আপন করে না নিয়ে নিতান্ত বুয়া বানিয়ে রেখেছে। বুয়া ঘরে কাজ করলেও ঘরের লোক নয়, বেতন দিয়ে ভিন্ন করে রাখা এক অনাত্মীয় কর্মী মাত্র। ভারত ছিল ইংল্যন্ডের কলোনী, তাই ভারতবাসী নিজে ইংরেজ বলে স্বীকৃত হয় নি। ভারতের লোক এমন দাবি করতে পারতো না যে আমরা ইংল্যান্ডের অধিবাসী, কারণ ভারত ইংল্যান্ডের অঙ্গ হয় নি, ছিল নিতান্তই ইতর অনঙ্গমাত্র। ভারত ছিল ইংরেজের চর বা খোলা, ঘর নয়।
৫।তাই উনিশ শতকের শেষে এসে দেখি অদ্ভুত ঘটনা। ১৮৯৮ সালে আমেরিকা তাদের কলোনী ফিলিপাইন্স কে স্বাধীনতা দিয়ে সরে পড়েছে। ফিলিপিনোরা আর অবাধে আমেরিকায় যেতে পারবে না, আমেরিকায় গিয়ে নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব হিসাব বদল হয়ে দেখা গেল সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের উপনিবেশগুলিকে ছেড়ে দিচ্ছে, বিনা যুদ্ধেই। নিবাস নয়, উপ-নিবাস, তাও দখলে রাখলে লস মানে বড় লস। লাভ নেই আর এইসব দখলদারিতে। কারণ, কৃষি এখন হীন এবং হেয়, সামান্য এবং তুচ্ছ। জমি এখন ময়লা ধূলাবালি মাত্র। ২০১৭ সালের হিসাবে বিশ্বজোড়া কৃষি থেকে এসেছে আয়ের ০৩.৮৩ শতাংশ, এত কম যে এটা ভুলে যাওয়াই মঙ্গল, মনে রাখাই লজ্জার। নতুন করে দখল করা কেন, আগে থেকে দখলে থাকা জায়গা জমি থেকে ঔপনিবেশিক প্রভুরা সরে পড়েছে। দুচারটা দস্যু দখলদারিত্ব করতে চেয়েছে বরাবর, কিন্তু এদের সংখ্যা ক্রমেই কমে গেছে।
এর উলটা ঘটনাও বুঝা দরকার। কানাডার অঙ্গ হয়ে কুইবেক যে সুবিধা পেয়েছে সেটা ভুলে গিয়ে কুইবেককে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র করার কল্পনা কিছু মানুষের মনে ছিল। কিন্তু গণভোটে বারেবারেই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হেরে গেছে। এমন দুইচার জন স্বপ্নবিলাসী অবাস্তব কল্পনার লোক মাঝে মাঝে ভেবে বসে যে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলা একসাথে করে একটা নতুন স্বাধীন দেশ বানালে মহা মঙ্গল হবে। এ হচ্ছে বাস্তবতাবোধ বর্জিত লোকের অলীক কল্পনামাত্র।
হিসাব করে ভেবে চিন্তে লোকে দেখে যে আধুনিক কালে বিবাহিতা নারীকে স্বামী থেকে স্বাধীন করে ফেলার যুক্তি নেই, আবার কাজের বুয়াকে বউ বানিয়ে ঘরে নিয়ে আসারও দরকার নেই। শতশত আলাদা রাজ্য নানা ঐতিহাসিক ঘটনায় একসাথে থেকে থেকে এক পরিবার হয়ে গেছে, সেগুলি ভেঙ্গেও লাভ নেই, আর যা একসাথে হয়নি তা জোড়া দিয়েও লাভ নেই। ফেডারেলিজম জিনিসটা বেশ জটিলঃ ভারতের অঙ্গ হয়েও পশ্চিম বাংলা কারো পরাধীন নয়ঃ আলাদা একটা রাজ্য হিসাবে তার বিস্তর অধিকার আছেঃ এই হল ফেডারেলিজম।
৬। কৃষিজমি থাকা এখন হয়ে গেছে লজ্জার, আর দরিদ্রতার প্রমাণ। বসুন্ধরায় আমার এক প্রতিবেশীর ছেলে নর্থ-সাউথ থেকে বিবিএ শেষ করার আগেই ইন্টারনেট থেকে কাপড়ের ব্যবসা করে মাসে তিন-চার লাখ টাকা রুজি করে। একদিন গ্রাম থেকে তার এক লুঙ্গিপরা মামা এসে হাজির, আমি তখন অই বাসায় চা খেতে গিয়েছি। ছেলের মামা গর্বের সাথে বলছেন গত বছর তিনি দুই লাখ টাকার ধান বিক্রি করেছেন। তার চাচাত বোনের এই বাচ্চা ছেলে মাসে তিন-চার লাখ আয় করে শুনে তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমি একজন অধ্যাপক এই কথা শুনে তিনি আমাকে চেপে ধরলেন এটা কি করে সম্ভব বুঝিয়ে দিতে। তিনি বারবার আবৃত্তি করছেনঃ কৃষিই জাতির মেরুদন্ড। তিনি জানেন না দুনিয়া বদল হয়ে গেছে।
৭। এই গ্রাম্য মামার কাছে আমরা কি করে বুঝাই যে বাংলাদেশের ক্ষেত দখল করে দিল্লীর লোকের কোন লাভ নাই, আছে কেবল ক্ষতি। এই মামাটির জন্য আমাদের প্রতিবেশি তরুণের ঘাড়ে আসলে বোঝা চাপানো হয়েছে। তিনি মক্কা যাবেন, দোয়া চাইতে এসেছেন শুনে আমাদের সেই তরুণ নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে উনাকে বলেছেঃ ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য আম্মার জন্য খাস করে দোয়া করবেন। বাংলা দখল করলে দিল্লীর হবে সেই দশাঃ ভর্তুকি দিতে হবে বিশাল অঙ্কে।
৮। মাথাটা শতকরা পাঁচ হাজার ভাগ নষ্ট না হলে কেউ আর বিদেশ দখল করতে যাবে না, কারণ বিদেশের জমি মানেই বিপত্তি, যা সম্পত্তির একদম উলটা। পুয়ের্টো রিকোর লোকজন গণভোট করে আমেরিকার অঙ্গরাজ্য হবার প্রার্থনা করলঃ আমেরিকা বলে দিল হবে না। কোন দুঃখে আমেরিকা যাবে অই দেশকে নিজের অঙ্গ বলে মেনে নিতে? অই দেশকে তারা চর বানিয়ে রেখে নাম দিয়েছে টেরিটরি (কলোনি)। পুয়ের্টো রিকোর লোক স্বাধীনতা প্রতিহত করতে সদাই তৎপর, কিছুতেই স্বাধীনতা মেনে নেবে না।
কে কাজের বুয়াকে বিয়ে করে বউ বানাবে?
অস্ত্রেলিয়া চেয়েছিলো আদিবাসীদেরকে একটা অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন করে ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়ে দিতে । আদিবাসীরা বললঃ স্বাধীনতার নামে আমাদেরকে বঞ্চনা করে সাবসিডী দেওয়া বন্ধ করতে চাও, সে হবে না বাছা। স্বাধীনতার চেয়েও বেশি দামী আমাদের ভর্তুকী- সে দাবি আমরা ছাড়বো না। ভিসার বাঁধাবিপত্তি দিয়েও যে বাঙ্গালকে ভারতে যাওয়া থেকে ফিরানো যায় না, সেই বাঙ্গাল ভারতের নাগরিক হয়ে গেলে ভারতের কি উপকার হবে?
৯। আর বাঙ্গালের প্রতি এতো অবজ্ঞা কেন? এই ছেলেরা কি যুদ্ধ করা ভুলে গেছে? ভারত এলো, দখল করল আর বাঙ্গালরা সব অবাঙ্গাল হয়ে গেল আর অবাঙ্গালরা বাঙ্গাল হয়ে গেলো, এতোই সোজা? একটা স্বাধীনচেতা জাতির সম্বন্ধে এই ধরণের অবজ্ঞার প্রকাশ ভালো কিছু নয়।
১০। বাংলাদেশে অবাঙ্গালী মীরজাফর আর বাঙ্গালী গোলাম আযম জন্ম হবেইঃ এতো লোকের মাঝে কিছু তো নষ্ট লোক থাকবেই। কষ্ট লাগে যখন কেউ অকাতরে ভাবতে পারে বাংলাদেশকে বিদেশীরা দখল করে নেবে। আগে ঘটেছে, আবার ঘটা অকল্পনীয় নয়, কিন্তু একজন এই সম্ভাবনার কথা মাথায় আনে কেন? যার পুরুষত্ব আছে সে এই ভয়ে ভীত নয়। সে নিজ দেশের স্বাধীনতা বাঁচাতে সদাই প্রস্তুত।
jannatul publisher