Answered 3 years ago
দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আব্দুল করিমের সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। শৈশব থেকেই একতারা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। জীবন কেটেছে সাদাসিধে ভাবে। বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের তালিম নেন কমর উদ্দিন, সাধক রসিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহিম মোস্তান বকসের কাছ থেকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের তালিম নিতে থাকেন কমর উদ্দিন, সাধক রশিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহীম মোস্তান বকশ এর কাছ থেকে। দীর্ঘ এ সঙ্গীত জীবনে বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের পাশাপাশি ভাটিয়ালি গানেও বিচরণ ছিল তাঁর। লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ ও দুদ্দু শাহ এর দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিলেন আব্দুল করিম।
২০০০ সালে তিনি কথাসাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক পান। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর পাওয়া অন্যান্য পদক ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে- রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পদক ২০০০, আইডিয়া সংবর্ধনা স্মারক ২০০২, লেবাক অ্যাওয়ার্ড ২০০৩, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০০৪, অভিমত সম্মাননা ২০০৬, সিলেট সিটি কর্পোরেশন সম্মাননা ২০০৬। এছাড়া দ্বিতীয় সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা এবং ‘অটোবি’র আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন আব্দুল করিম।
মাত্র আট দিন ব্রিটিশদের পরিচালিত নৈশ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গুজব রটানো হলো বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। সেই আশঙ্কায় সকল ছাত্রের সাথে সাথে তিনিও ছাড়লেন বিদ্যালয়। কিন্তু নিজের চেষ্টা আর সাধনায় কাজ চালানোর মতো পড়াশোনা ঠিকই শিখেছিলেন তিনি। সেই পড়াশোনা আর জীবনের বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে রচনা করে ফেলেন প্রায় দেড় হাজার গান। যার অনেকগুলোই এখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বাউল মানেই মানুষ বোঝে যে নির্দিষ্ট একটা ধারায় জীবন পরিচালিত করা ও নির্দিষ্ট ধারায় গান গেয়ে বেড়ানোকে। কিন্তু একতারা হাতে নিয়ে গান গাওয়া বাউলও যে অতি আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ হতে পারেন, প্রগতিশীলতার চর্চা করতে পারেন, গণমানুষের অধিকার নিয়ে হতে পারেন সোচ্চার- তা বুঝতে হলে শাহ আবদুল করিমের জীবন, গান ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করলেই কেবল তা বোঝা সম্ভব।
নিজের স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন করিম। আফতাবুন্নেসা নাম হলেও তিনি আদর করে ডাকতেন সরলা। তার জীবন ও গানে স্ত্রীর প্রেরণার কথা বারবার বলে গেছেন। এমনকি স্ত্রীকে নিজের মুর্শিদও বলতেন তিনি। প্রকাশিত প্রথম বই আফতাবসঙ্গীতও স্ত্রীর নামে নামকরণ করেছিলেন। তবে পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় স্ত্রীর মৃত্যুতে কষ্ট পাওয়ার কথা বারবার বলে গেছেন।
অসংখ্য গণজাগরণের গানের রচয়িতা বাউল শাহ আব্দুল করিম অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। গানে-গানে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি লড়াই করেছেন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এজন্য মৌলবাদীদের দ্বারা নানা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মানুষকে প্রেরণা জোগায় শাহ আবদুল করিমের গান। বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের গানের মধ্যদিয়ে তাঁকে খুঁজতে প্রতিদিন ভক্ত ও স্বজনরা গানের আসর বসান। গানের মধ্যে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতেই সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান ভক্ত-আশেকানরা।
সারাজীবন দেশের মানুষকে গান দিয়ে আনন্দ দিয়েছেন, বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে উদ্ধুদ্ধও করেছেন। কিন্তু জীবিত থাকতে স্বীকৃতি পাননি সে তুলনায় খুব একটা। তবে জীবনের শেষদিকে এসে চারদিক থেকেই অনেক স্বীকৃতি পেতে থাকেন। ২০০১ সালে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক পান। এরপর পান মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা। তার ১০টি গান বাংলা অ্যাকাডেমি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অসংখ্য শিল্পী তার গান গাইতে থাকেন সর্বত্র। ফলে মৃত্যুর আগেই করিম হয়ে ওঠেন দুই বাংলার লোকগানের এক স্বর্গীয় যাদুকর। তাকে নিয়ে নির্মাতা শাকুর মজিদ তৈরি করেন 'ভাটির পুরুষ' নামের প্রামাণ্যচিত্র। রঙের মানুষ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়। তার জীবনে নিয়ে তৈরি মঞ্চনাটক 'মহাজনের নাও' এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি প্রদর্শনী করে ফেলেছে।
গানের জন্য যার মন পাগলপারা থাকতো, গান ছাড়া আর কিছুই যার মন চাইত না, তার কণ্ঠ চিরতরে থেমে যাওয়ার, তার প্রস্থানের এক দশক পূর্ণ হয়ে গেলো। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো আজও এই পৃথিবীটা বাউলের হয়নি, আজও বাউলরা নিগৃহীত উগ্রবাদীদের দ্বারা। করিমকে যদি আমরা সম্মান জানাতে চাই, তবে অবশ্যই তার স্বপ্নের পৃথিবী গড়তে হবে আমাদের। যেখানে গান গাওয়ার জন্য আর কোনো বাউলকে নিপীড়িত, নির্যাতিত হতে হবে না। পৃথিবীটা যেদিন সত্যি বাউলের হবে সেদিন করিম-দর্শন পাবে স্বার্থক রূপ। সেদিনের অপেক্ষাতেই থাকবে আমাদের মতো করিমপ্রেমী সকলেই।
২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম মৃত্যু বরণ করেন। সেই দিন শনিবার সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আব্দুল করিমকে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর থেকেই লাইফসাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল।
Alia Khatun publisher