Answered 3 years ago
র্যাগিং এর সাথে প্রথম পরিচিত হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং এর ঐতিহ্য চলে আসছে ৪-৫ দশক ধরেই। প্রশ্ন হচ্ছে র্যাগিং কি ভালো না খারাপ? চলুন এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেডিয়েট সিনিয়র ব্যাচ নামে একটা টার্ম আছে। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হই আমার ব্যাচ ছিল ৪৬। স্বাভাবিকভাবে আমার ইমেডিয়েট সিনিয়র ব্যাচ ছিল ৪৫। যেদিন প্রথম হলে উঠলাম সেদিন রাত ১২ টার পর ৪৫ তম ব্যাচের বড় ভাইরা আমাদের গনরুমে আসলো। আচ্ছা গনরুম সম্পর্কে যারা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও ভর্তি হয়ে নতুন ছাত্রছাত্রীদের গনরুমে থাকতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো সব ছাত্রছাত্রীর জন্য প্রথম থেকেই রুমের বরাদ্ধ দিয়েছে। তাহলে এত রুম গেলো কোথায়? যেসব ছাত্র বা ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করে বের হয়ে হলের সিট ছেড়ে দেয়ার কথা, তারা রাজনীতির জোরে নির্লজ্জ্বের মত সিট দখল করে বসে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতটাই মেরুদণ্ডহীন যে তাদের সাহস নেই এসব আদুভাই পলিটিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের হলের সিট ছাড়তে বাধ্য করতে। তাই বাধ্য হয়ে নতুন ছাত্রছাত্রীরা প্রথম এক বছর গণরুমে রাখে। গণরুম হলো বিশাল হলঘরের মত একটা রুম, যেখানের নোংরা পরিবেশে ফ্লোরিং করে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীগুলো মানবেতর জীবন যাপন করে।
গনরুমে নতুন ছাত্রছাত্রীদের রাখার আরেকটা কারণ আছে। সেটা হলো এই ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজনৈতিক দলে টেনে নেওয়া। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছাত্রছাত্রীরা বিশবিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। তারা অনেক স্বপ্ন নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়ঃ যেমন একজন মেধাবী তরুন বা তরুনী স্বপ্ন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে একদিন দেশটাকে বদলে দিবে, ঠিক তেমনি অজপাড়া গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন মেধাবী তরুন বা তরুনী স্বপ্ন দেখে নিজের পরিবারের ভাগ্য বদলে দেয়ার। সত্যি যদি নতুন ছাত্রছাত্রীদের প্রথম থেকেই রুম দেয়া হতো তাহলে তারা প্রথম থেকেই পরাশোনায় মনোযোগী হয়ে পড়তো। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তা হতে দিবে কেন? এতে তাদের কি লাভ? পড়াশোনা করে একজন সত্যিকারের মানুষ তৈরি হলে, সে দেশের উন্নয়ন করবে, এতে রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতি করার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। বরং একটা ছাত্রকে যদি তাদের দলে টানা যায়, সে তাদের হয়ে রাজনৈতিক দলের মিছিলে যোগ দিবে।
আসল ঘটনায় ফিরে আসি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন ৪৫ তম ব্যাচের ভাইয়েরা রাত ১২ টার পর আমাদের রুমে শীনা টানটান করে এলো। এসেই হুমকি-ধমকি শুরু, যেন আমরা ছাত্র না, যেন আমরা কারাগারের কয়েদী, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে আমরা অনেক বড় অপরাধ করেছি। এরপর শুরু হয় নিয়ম-কানুন বলা। সিনিয়রকে দেখলেই সালাম দিতে হবে, ফুলহাতা শার্ট পরে রুম থেকে বের হতে হবে। এরকম প্রতি রাতে সিনিয়ররা রাত ১২ টায় এসে ২ টা পর্যন্ত র্যাগিং দিতো। অনেক হলে তো রাত ৪ টা পর্যন্ত ও থাকতো। এত রাত পর্যন্ত র্যাগিং এর শিকার হয়ে পরেরদিন সকালে ক্লাস করার কোনো ইচ্ছাই থাকতো না। একপর্যায়ে ছাত্রছাত্রীরা বুঝে যেতো এ দেশে পড়াশোনার কোনো দাম নেই, এ দেশে বড় কিছু করতে হলে রাজনীতি করতে হবে। তাদের কোমল হৃদয়ে এই আইডিয়া ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, এই দেশে ক্ষমতা যার, দেশটা তার। এইজন্য দেখবেন এখন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজের বিষয়ের পড়া বাদ দিয়ে দলবেধে বিসিএস এর জন্য পড়ছে। কারণ বিসিএস ক্যাডার হলেই তো ক্ষমতার প্র্যাকটিস করতে পারবে।
একদিন বিকেলের ঘটনা। আমি জাহাঙ্গীরনগর শহীদ মিনারের সামনে ঘাসের উপর বসে পড়ছিলাম। এক সিনিয়র ভাই আমাকে পড়তে দেখে যেন গাছ থেকে পড়লেন। আমি যেন কোন মহাপাপ করছি, তাই সে পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য তিনি এগিয়ে এলেন। আমাকে বুঝালেন সবে তো ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। এখন কিসের পড়াশোনা!!! পরে জানতে পারলাম সেই সিনিয়র ভাই নিজেই দুইবার রিটেক খেয়ে বসে আছে, আরেকবার রিটেক খেলে ইউনিভার্সিটি লাথি মেরে বের করে দিবে। তখন আমার মনে পরে গেলো ঈশপের সেই বিখ্যাত লেজ কাটা শেয়ালের গল্প। জাহাঙ্গীরনগরে আমি প্রায় সময়ই লক্ষ্য করতাম পড়াশোনা করাটাকে নিরুৎসাহিত করা হত। এর পিছনে যুক্তি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শুধু পড়াশোনা করতে এসেছো নাকি, এখানে মানুষের সাথে মেলামেশা করা শিখতে হবে, এই শিখতে হবে ওই শিখতে হবে, কিন্তু পড়াশোনা করা যাবেনা। পড়াশোনা করলেই আতেল ট্যাগ দেয়া হবে।
আমি প্রথম থেকেই ইমেডিয়েট সিনিয়রদের পরোয়া করতাম না। আমার কাছে তাদেরকে ব্যক্তিত্বহীন মনে হতো। ব্যক্তিত্বহীন না হলে যেচে যেচে জুনিয়রদের সালাম খুঁজবে কেন? একবার বটতলায় এক সিনিয়র আপু আমাকে ডাক দিলেন। বললো, তুমি রাশেদ না? আমি তাকে চিনতে পারলাম না। তিনি খুব রেগে গেলেন। বললে্ এত ভাব তোমার? সিনিয়রদের পাত্তা দাওনা। আমি তখন বলতাম, আপু আপনি নিশ্চয়ই এমন কোনো বিশেষ কাজ করতে পারেননি য,র কারনে আপনাকে মনে রাখবো। কিন্তু কি ভেবে যেন আর বললাম না। সে আপু কিছু পলিটিক্যাল ভাইকে ডাকলেন আমাকে শায়েস্তা করার জন্য। সারা রাত ধরে সেন্ট্রাল ফিল্ডে চললো আমার র্যাগিং। আমাকে গান গাইতে বলে, নাচতে বলে। আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করা হলো আমি সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলি না, তাই নাকি আমি স্মার্ট না। আমাকে স্মার্ট হতে হলে নাকি সবার সাথে মিশতে হবে। যদিও আগে থেকেই আমার পরিকল্পনা ছিল জাহাঙ্গীরনগর ছাড়ার, সে রাতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই জায়গা আমার জন্য না।
কয়েকদিন আগে সোস্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট ভাইরাল হলো। ঢাকা ভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র শহীদ মিনারে বসার অভিযোগে ঢাকা মেডিকেলের একজন ইন্টার্ন ছাত্রকে মারধর করেছে। তাদের নৈতিকতা কতটা নিচে নেমে গেলে তারা এত অমানবিক কাজ করতে পারে! এসব অমানবিক কাজ তারা গণরুমের বড় ভাইদের থেকেই শিখে। এছাড়াও এই গণরুম থেকেই তারা মাদকের প্রতি ঝুঁকে যায়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়াশোনার নামে কি চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এই অসুস্থ সংস্কৃতি অচিরেই থামানো না গেলে, দেশটা গোল্লায় যাবে।
Moushumi Hamid publisher