Answered 2 years ago
লেপমুড়ি দেওয়া শীত আগত অতিথি। কমলালেবু সুবাসিত রোদ আর শুভাসিত শিরশিরানি বাতাস নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম। লালচে সুগন্ধী নলেন গুড়ের সঙ্গে কড়াপাকের সন্দেশ ও রসগোল্লার সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি এই গুড়ের কাঁধে ভর দিয়ে জয়প্রিয়তায় চূড়ায় পৌঁছে গেছে ‘জয়নগরের মোয়া’।
অস্তিত্বের সঙ্কট
দার্জিলিং চায়ের পরে এবং রসগোল্লার যথেষ্ট আগে বাংলার দ্বিতীয় যে উত্পাদন (পড়ুন মিষ্টি) জি আই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি পেয়েছে তার নাম ‘জয়নগরের মোয়া’। এই মোয়া যে ধরনের অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছিল তাতে এই জি আই প্রাপ্তির প্রয়োজন ছিল। আসলে একটা সময় গিয়েছে যখন কলকাতা ও শহরতলীর সর্বত্র, এমনকী কলকাতার বাইরেও উপযুক্ত গুনমানের পরোয়া না করে বছরের পর বছর ধরে এই মোয়া তৈরি হতে শুরু করেছিল। নিম্নমানের খইয়ের সঙ্গে নলেন গুড়ের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে এই সব মোয়া বছরভর তৈরি হত। অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মানুষ এই ভেজাল মোয়া খেয়ে খেয়ে জয়নগরের মোয়ার আসল স্বাদ ভুলতে বসেছিল। শীতের কয়েক মাস ধরে তখন নানা স্থানে এই নিকৃষ্ট মানের মোয়া ‘আসল জয়নগরের মোয়া’র সিলমোহর লাগিয়ে বিক্রি হত। সে-সময় রসিকজনের পক্ষে আসল মোয়া কেনা ছিল এক বিশাল পরীক্ষা। আর যাঁরা অভিজ্ঞ নন, তাঁদের ঠকে যাওয়াটাই ছিল স্বতঃসিদ্ধ। জি আই প্রাপ্তির পরে স্বীকৃতিহীন যে কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জয়নগরের মোয়া বানিয়ে বিপনন করা আইনত দণ্ডনীয়।
বিশ্বজয়
২০১১ সাল থেকে চেষ্টা করে ৪ বছর পরে ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ জি আই শিরোপা পাওয়ার পর অন্তত প্রামাণ্যতার বিচারে জয়নগরের মোয়ার অস্তিত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘জয়নগর মোয়া নির্মানকারী সোসাইটি’ রাজ্য সরকারের সঙ্গে মিলিতভাবে জি আই প্রাপ্তির জন্য আবেদন করেছিল। এই সোসাইটির সদস্য সংখ্যা তখন ২৬৫। তবে খুব স্বল্পসংখ্যক সদস্য মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানই জি আই ট্যাগ ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। বর্তমানে এই মোয়া প্রামাণ্যতার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট লোগোও পেয়েছে। খাঁটি মোয়ার প্যাকেটে এই লোগো লাগানো থাকবে, যা দেখে ক্রেতার পক্ষে আসল মোয়া চিনতে অসুবিধে হবে না। তবে এতেও যে খুব সুবিধে হয়েছে এমন নিশ্চিত করে বলা যায় না, কারণ, ভেজাল মোয়া তৈরি বন্ধ করা যায়নি। আজও উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্যত্র, কলকতা শহর ও শহরতলি, এমনকী সংলগ্ন নদীয়া বা অন্য জেলাতেও ভেজাল মোয়া তৈরি হয়ে আকর্ষনীয় প্যাকেটে ভরে বিক্রি হচ্ছে। এটা রোধ করতে যা দরকার তা হল, প্রশাসনের তরফে নজরদারি।
ফিরে দেখা
জয়নগরের মোয়ার বয়স এখনও একশো হয়নি। সেরকম প্রামাণ্য নথী কিছু না মিললেও কিছু জনশ্রুতি আছে। কলকাতা থেকে ৪৭ কিমি দূরের জয়নগর নয়, এই মোয়া নাকি প্রথমবারের মতো তৈরি হয়েছিল সংলগ্ন বহেরু গ্রামে (ট্রেন লাইনে জয়নগরের আগের স্টেশন)। সেখানকার জনৈক যামিনীবুড়ো নিজের খেতে তৈরি কনকচূড় ধানের খই ও নলেন গুড় দিয়ে এই মোয়া তৈরি করেন, এমনটাই প্রচলিত তথ্য। ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে এই মোয়া পরিবেশন করাই ছিল যামিনীবুড়োর মুখ্য উদ্দেশ্য। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, এই মোয়া প্রথম বিক্রি করতে শুরু করেন জয়নগর থানার অন্তর্গত শ্রীপুর গ্রামের জনৈক আশুতোষ দাস। তিনি জানবাজারের রানী রাসমনির বাড়িতে পর্যন্ত এই মোয়া পৌঁছে দিতেন। যাইহোক, সুস্বাদু এই মোয়া পরবর্তীকালে জয়নগর থেকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উত্পাদিত হতে শুরু করে। পূর্ণচন্দ্র ঘোষ (পূর্ণ) এবং নিত্যগোপাল সরকার (বুঁচকি) যৌথভাবে প্রথম জয়নগরে মোয়া তৈরীর কারখানা ও দোকান স্থাপন করেছিলেন। সেটা আনুমানিক ১৯২৯ সাল। পূর্ণবাবু ও বুঁচকিবাবু ছিলেন বাল্যবন্ধু। দুজনেরই মামাবাড়ি ছিল জয়নগরে। যেহেতু জয়নগর থেকে এই মোয়ার সংগঠিত বিপনন শুরু হয়েছিল, তাই এই মোয়ার আগে ‘জয়নগর’ নামটি যুক্ত হয়ে যায়। তবে স্বাভাবিক কারণেই বহেরুর মোয়া প্রস্তুতকারীদের এই নাম ভাল লাগেনি। জয়নগরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেখানেও এই মোয়া দেদার
বৈশিষ্ট্য
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কুলপি, কাকদ্বীপ ও নামখানা অঞ্চলের সামান্য কিছু জমিতে শুধুমাত্র শীত আসার আগে আগে সুগন্ধী কনকচূড় ধান উত্পাদিত হয়। কোনওরকম রাসায়নিক সার ব্যবহারে কনকচূড় ধানের গুনমানের পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে এই বিশেষ প্রজাতির ধান চাষে সনাতন প্রথা মেনে জৈব সার ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, উপকূলবর্তী নোনা আবহাওয়ায় খেজুর গাছের বাড়বাড়ন্তের পক্ষে অনুকুল হওয়ায় এই অঞ্চলে সেরা নলেনগুড়ের আধিক্য ঘটেছে। জয়নগরের মোয়ার স্বাদের জাদু-মাহাত্ম্য ওই কনকচূড় ধানের খইয়ের অন্তরে লুকিয়ে আছে। আর তাতে রসনার সেরা রাগিনীর সুর বেঁধে দিয়েছে নলেন গুড় ও গাওয়া ঘি। জয়নগরের মোয়ার জি আই প্রাপ্তির মূলেও আছে এই দুই উপাদনের বিশেষ রকম ভৌগোলিক অঞ্চলভিত্তিক অবস্থিতি। তাই চাইলেও অন্য কোনও জেলা বা রাজ্য এই খাবার তৈরি করতে পারবে না।
যেভাবে তৈরি হয়
এই মোয়ার জন্য শুধু কনকচূড় ধানের খই হলেই চলবে না, গুনমানে তাকে একেবারে সেরার সেরা হতে হবে। এই খইয়েরও আবার ‘পুরুষ’/‘নারী’ নামে রকমফের আছে। একমাত্র অভিজ্ঞ কারিগরের সন্ধানী চোখ ছাড়া সে খই ধরতে পারা অন্যের পক্ষে মুশকিল। এছাড়া মোয়াকে আরও স্বাদু করে তুলতে এর সঙ্গে খোয়াক্ষীর, চিনি, পেস্তা, কাজুবাদাম, এলাচ, কিশমিশ ও পোস্ত ব্যবহার করা হয়। তবে প্রকৃত স্বাদ ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে অনেক প্রস্তুতকারক উপরোক্ত উপাদানগুলির ব্যবহার নিয়ন্ত্রন করার পক্ষপাতী। বলা বাহুল্য, নলেন গুড়ের উৎস খেজুর গাছ।
খেজুর গাছ থেকে শীতকালে উত্কৃষ্ট মানের খেজুর রস সংগ্রহ করেন যাঁরা, তাঁদের শিউলি বলা হয়। তবে যে কোনও খেঁজুর গাছের রসে এই মোয়া হবে না, গাছটিকে অন্তত ১০ বছর বয়স্ক হতে হবে। আর তা থেকে রস সংগ্রহও করতে হবে বিশেষ উপায়ে। এর জন্য নির্দিষ্ট দক্ষতা ও প্রচণ্ড কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। এর পরের ধাপে রস থেকে গুড় তৈরি হওয়ার পদ্ধতিতেও বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্পের যুগলবন্ধী ঘটেছে। সংগৃহীত সেই রস ঢিমে আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরী করা হয় নলেন গুড়। অল্প গরম সেই গুড়ে কনকচূড় ধানের খই ফেলে ধীরে ধীরে নলেন গুড় মেশানো হয়। সেই গুড়মাখা খই ঠান্ডা হওয়ার পর ভাল ঘি ও অন্য উপাদান মিশিয়ে মোয়া বাঁধা হয়। খাঁটি মোয়ার বৈশিষ্ট্য হল, সেটি মুখে দিলে গলে যাবে। অন্য কোনও জেলায় এই দুইয়ের মিশেল সম্ভব নয়। তাই এত ভাল মানের মোয়া তৈরি করাও সম্ভব হয় না। সাধারণ খইয়ে তৈরি মোয়া হয় শক্ত। দেখতে অবিকল জয়নগরের মোয়ার মতো হলেও স্বাদে তা ধারেকাছে আসে না। তাছাড়া শীতের কয়েক মাসেই এই মোয়া মেলে, কারণ মূল উপাদান কনকচূড় ধান ও নলেন গুড় এই সময়েই হয়। তবে শুধু উত্কৃষ্ট ও বিশুদ্ধ উপাদান মিশিয়ে দিলেই যে সুস্বাদু জয়নগরের মোয়া তৈরি হবে তা নয়। এতে অন্যতম ভূমিকা নেয় মোয়াশিল্পীদের হাতের জাদু। খই বেছে নেওয়ার চোখ, বংশ পরম্পরায় বাহিত হয়ে আসা গুড় ও খইয়ের অনুপাত এবং এই দুইয়ের মিশ্রণকে ফোটানোর গোপন কৌশল সবার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
Masum publisher