Answered 3 years ago
বাংলাদেশের ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Dhaka) ভালো একটা ডিপার্টমেন্ট (Accounting & Information Systems) থেকে বেশ ভালো রেজাল্ট নিয়েই পড়াশোনা শেষ করেছি ২০১৬ সালে। এর পর থেকেই পুরোদমে ব্যবসায় করছি ঢাকাতে।
প্রথমে নিজের সম্পর্কে একটু বলে নেই। তাহলে উত্তরটি আরো বোধগম্য হবে।
- অনার্স, মাস্টার্স তো প্রথমেই বললাম
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Admission Test এ ৮ম হয়েছিলাম (মধুর স্মৃতি)
- কলেজ নটর ডেম, HSC তে গোল্ডেন A+, বোর্ডে ২০ এর মধ্যে
- স্কুল Ideal School and College, SSC তে গোল্ডেন A+, বোর্ডে ২০ এর মধ্যে
নিজের সুনাম করার জন্য নয়, অবস্থানটা বোঝানোর জন্য বলছি - আমি স্টুডেন্ট ভালোই। ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি এমন মানুষদের যারা Dhaka Stock Exchange, Chittagong Stock Exchange, ICAB, ICMAB সহ বিভিন্ন প্রতিস্থানের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন । সহপাঠী ও সিনিয়র হিসেবে তাদের পেয়েছি যারা অসাধারণ ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে ভালো ভালো পদে কর্মরত আছেন।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো - গুটি কয়েকজন ছাড়া কেউ কখনো ব্যবসায় উৎসাহ তো যোগাননি বরং বার বার এর থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। যখনই কেউ জেনেছে যে আমি ব্যবসায় করব, তখনই বলতে শুনেছি -
তুমি ভালো স্টুডেন্ট, B.C.S. দেও। পেয়ে যাবা, তখন সারা জীবনের জন্য শান্তি।
তুমি ভালো স্টুডেন্ট, স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ চলে যাও। এই দেশে কিছুই হবে না।
ব্যবসায় করবা, মাথা খারাপ হতেই পারে। কিন্তু এত পাগল হইয়ো না। ভালো একটা MNC (Multi-National Company) তে join কর। লাখ লাখ টাকা বেতন পাবা।
ভালো Student রা ব্যবসায় করে না। ব্যবসায় এর লাইনটা অনেক নীচের।
বাবার কলিগরা বাবাকে বলত - ছেলেটাকে এভাবে নষ্ট হতে দিও না ।
ব্যবসায় যদি করতেই হয় তাহলে আগে কোন একটা ভালো চাকরি কর। টাকা জমাও, এর পর না হয় দেখা যাবে।
মানে ব্যাপারটা হল- নেতিবাচক কথা ছাড়া আর কিছুই বলতে শুনিনি সাধারণত, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বার বার মনে হত, সবাই এত ভয় দেখায় কেন? এত ভয় পায় কেন? কী আছে এই ব্যবসায়তে?
এই তো বললাম ব্যাকগ্রাউন্ড। আবার আসি আসল কথায়। আস্তে আস্তে সব কিছুর মধ্যে একটা প্যাটার্ন খুঁজে পেলাম। আশেপাশের সবাইই সেখানেই যেতে বলছে যেখানে একটা নিরাপত্তা আছে, যেখানে সবকিছু কিছুটা হলেও Predictable। আর সবার মতে ব্যবসায় হচ্ছে সেটার পুরোপুরি বিপরীত।
যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম - নাহ, ব্যবসায় আমি করবোই। বাঁচি আর মরি, এটার সাথেই থাকবো। এখনো সবার একই প্রশ্ন - তোমার Plan B কী? আমার উত্তর - আমার একটাই প্ল্যান।
তো যাই হোক অধিকাংশ বাঙালি চায় একটা ভালো চাকরি কিন্তু ব্যবসা নয়, এর কারণ কী? এর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এত কথার অবতারণা ।
আমার মতে এর মূল কারণ হচ্ছে নিজের প্রতি বিশ্বাসের অভাব। আমি ব্যবসায় করতে গিয়ে কী দেখছি জানেন? (অসৎ ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে শুধু সৎ ব্যবসায়ীদের কথাই বলছি)
সব জায়গায় বেশিরভাগ বড় ব্যবসায় এর মালিকরা হচ্ছেন খুবই অল্প-শিক্ষিত
ঢাকার বিভিন্ন ইন্ড্রাস্টিতে সব বড় বড় Supplier যারা আছেন তারা নিজেদের নাম ছাড়া আর কিছু ভালোভাবে লিখতে পারেন না। কিন্তু তাদের অধীনে বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে মানুষ কাজ করছে।
মাসে ২০ লক্ষাধিক মুনাফা এর বেশি অধিকারী বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন নি।
পড়াশোনা জানা বেশিরভাগ ছাত্রের শুরুর বেতন হয় ৩০ হাজারের আশেপাশে। কিন্তু বেশ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের এলাকায় সিঙ্গারা বিক্রেতার মুনাফা এর চেয়ে বেশী।
শিক্ষিত সবাই Status জিনিসটা কে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আর সাধারণ ব্যবসায়ীরা বিক্রি করাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আমি নিজেও প্রথম প্রথম ভালো সমস্যায় পড়েছি এটা নিয়ে।
চাকরিতে কেউ বলে দেয় কী করতে হয়। মাস শেষে বেতনটা আসবেই যদি চাকরি থাকে। কিন্তু ব্যবসায়তে কোনো কিছুর ঠিক ঠিকানা নেই। নিজে কাজ করে যাওয়া আর আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
সুতরাং, ভালো চাকরি- ব্যবসায় নয় এটার কারণ হচ্ছে মানসিকতা। ভালো Student রা ব্যবসায় করবে না। ব্যবসায় করবে তারা যারা কিছুই পারে না - এই ভুল মানসিকতাই আমাদের বর্তমান সমাজে বিদ্যমান।
চাকরি অবশ্ই খারাপ না । কিন্তু চাকরিটা আমরা কেন করছি এটা গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার জন্য করলে ব্যাপারটা দুঃখজনক। পরম করুণাময় এছাড়া আর কিছুই আসলে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আমি নিজে ব্যবসায় করছি এবং শুকরিয়া আদায় করছি প্রতিদিন। অসাধারণ একটা journey এটা।
ব্যবসায় নিয়ে আমার পড়া একটি আর্টিকেলের কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি -
মুন্নু সিরামিকস বিশ্বে সিরামিকসের ক্ষেত্রে তিন নম্বর প্রতিষ্ঠান। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন বৈদেশিক আয়ের মূল উৎস। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার পরও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আজ থেকে ৪০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রধানত তিনটি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন-ব্যবসা, শিল্প এবং কৃষি। কৃষিতে তাদের মেধা এত বিকশিত হয়েছিলো যে, ৩৫০ প্রজাতির ধান উৎপাদন করতেন তারা। যত ধরনের সুগন্ধি মশলা আছে সবই তারা উৎপাদন করতেন।
শিল্পে তারা মেধাকে এত বিকশিত করেছিলেন যে, মসলিনের মতো সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি করতেন। টেক্সটাইল টেকনোলজির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন এই মসলিন। আজ পর্যন্ত তুলা থেকে এর চেয়ে মিহি কাপড় তৈরি করা সম্ভব হয় নি। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ আঁশের তুলা উৎপাদিত হতো যশোর ও বরেন্দ্র এলাকায়। আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতেন। চট্টগ্রামে জাহাজ তৈরি হতো। চট্টগ্রামে যে ‘বহদ্দার হাট’ রয়েছে সেটি ছিলো ‘বহরদার’ অর্থাৎ নৌবহরের দার বা প্রধানের জায়গা। আমাদের কারিগররা জাহাজ বানাতেন। সেই জাহাজে তারা জাভা, সুমাত্রা, মালদ্বীপ, সিংহল প্রভৃতি স্থানে যেতেন। বালিতে রামায়ণের নাটক অভিনয় তাদের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা এই বাংলা থেকে গিয়েছিলেন।
বাংলার বীর বিজয় সিংহ সিংহলের পত্তন করেন, সিংহল নাম তার নামানুসারেই। মধ্যযুগে ভাইকিংদের সাথে নৌযুদ্ধে এই বাংলা থেকে জাহাজ গিয়েছিলো। সমুদ্রযাত্রা আমাদের সংস্কৃতির এত অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো যে, চাঁদ সওদাগরের কাহিনীর মতো লোকসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সেসময় আমাদের এই উপমহাদেশের জিডিপি ছিলো বিশ্বের জিডিপির ২২-২৩%। আর তখন ইংল্যান্ডের জিডিপি ছিলো বিশ্ব জিডিপির এক শতাংশ মাত্র। মুর্শিদাবাদ ছিলো লন্ডনের চেয়েও বড় শহর। লাহোরের অধিবাসীর সংখ্যা ছিলো ২০ লক্ষ।
কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে আমাদের পেশা সংক্রান্ত ধ্যানধারণা পরিবর্তিত হতে শুরু করলো। আমাদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হলো যে, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল কাজগুলো করার কোনো ক্ষমতাই আমাদের নেই। আমাদের অবস্থা দাঁড়ালো খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতো। এন্ট্রিপ্রিনিউরাল স্পিরিট (entrepreneurial spirit) হারিয়ে আমরা নিজেদেরকে শুধুমাত্র চাকরিজীবী অর্থাৎ চাকর ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে শুরু করলাম।
যেখানে আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতো, সেখানে সৃষ্টি হলো কালাপানির ধারণা অর্থাৎ সমুদ্র যাত্রা যদি কেউ করে তো তার জাত চলে যাবে, জাতচ্যুত হবে। ফলে কালক্রমে আমরা পরিচিত হলাম দুর্ভিক্ষপীড়িত, বন্যা কবলিত, জরা-ব্যাধি জর্জরিত একটি জনপদ হিসেবে।
স্বাধীন পেশায় যাওয়া নিয়ে আপনার যে হতাশা, যে বিভ্রান্তি-ক্যারিয়ার সংক্রান্ত এ হতাশা ও স্থবিরতার মূলে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অবক্ষয়। যত আমরা পূর্বপুরুষদের সেই সাহসী চেতনাকে, সেই উদ্যোগ ও উদ্যমকে জাগ্রত করতে পারবো, তত আমাদের মেধাকে আবারো শতধারায় বিকশিত করতে পারবো। নিজের অনন্য মেধাকে সেবায় রূপান্তরের মাধ্যমে নিজেই গড়তে পারবো পরিতৃপ্তিময় কর্মজীবন।
ভালো থাকবেন। বাঙালি ব্যবসায় করুক আর চাকরি করুক - সৎ ভাবে থাকুক, সমাজের ভালোর জন্য কাজ করুক, এটাই কামনা থাকলো।
imtiyazahmed publisher