Answered 3 years ago
নাদিয়া মুরাদ, একজন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী নারীর নাম। নোবেল জয় করে গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করেছেন ইরাকের এই ইয়াজিদি মানবাধিকারকর্মী। বাস্তবতার কঠিন নির্যাতনের জাল থেকে বেরিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এ পুরস্কারটি অর্জন করলেন তিনি, তা নিয়ে অবাক পুরো বিশ্ব।
প্রথম ইরাকি হিসেবে নোবেল পাওয়া ২৫ বছর বয়সে। ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন পৃথিবী নির্মমতম জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বর্বরতা। শিকার হয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের। পার করেছেন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম কিছু সময়।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের এক গভীর রাতে ওমর আব্দুল জাব্বারদের মসুলের বাড়ির প্রধান ফটক থেকে যখন ঘন ঘন কড়া নাড়ার আওয়াজ আসছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। এত রাতে আইএসের প্রহরীরা ছাড়া অন্য কেউ আসার কথা না। কিন্তু দরজা খুলে যখন তারা দেখল আইএস না, বরং আইএসের বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে আসা এক তরুণী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে, তখনও তাদের আতঙ্ক বিন্দুমাত্র কমেনি। কারণ শহরটির জায়গায় জায়গায় তখনও জঙ্গি সংগঠন আইএসের চেকপয়েন্ট, এলাকার অনেকেই আইএসের সমর্থক। যেকোনো মুহূর্তে কেউ দেখে ফেললেই তাদের নিজেদের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
আইএস তথা ইসলামিক স্টেট বা দায়েশের বন্দী শিবির থেকে কারো পালানোর ঘটনা সেটাই প্রথম ছিল না। কিন্তু যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের অধিকাংশই দুই-এক দিনের মধ্যেই আবার ধরা পড়ে গিয়েছিল। পালিয়ে গিয়ে তারা যাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, অনেকক্ষেত্রে তারাই আবার তাদেরকে তুলে দিয়েছিল আইএসের হাতে। কেউ সেটা করেছিল নিজেরা আইএসের সমর্থক হওয়ার কারণে, কেউ করেছিল পুরস্কারের লোভে, আর কেউ করেছিল প্রাণের ভয়ে।
গভীর রাতে দরজায় নক শুনে ওমর এবং তার বাবা ভয়ে ভয়ে দরজা খোলেন। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখতে পান তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাট গড়নের এক তরুণী, যার আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা। মেয়েটি কাতর স্বরে তাদেরকে অনুরোধ করছিল, “আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে ধর্ষণ করছে।” ওমর এবং তার বাবার জন্য সেটা ছিল জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। পলাতক দাসীদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার ছিল ৫,০০০ ডলার। অন্যদিকে আশ্রয় দেওয়ার শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠোর, হয়তো মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তারপরেও সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে তাদের দেরি হয়নি। কেউ দেখার আগেই তারা আস্তে করে মেয়েটিকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেন।
নাদিয়াকে ঘরে লুকিয়ে রাখা ওমরদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তাকে বের করা ছিল আরো ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ হয়তো দেখে ফেলেছে, এরকম সন্দেহে তারা তাকে শহরের অপর প্রান্তে ওমরের বোনের বাসায় রেখে আসেন। এর মধ্যে ওমর তার এক কাজিনের মাধ্যমে নাদিয়ার নামে একটি নকল পরিচয়পত্র তৈরি করান। সেখানে নাদিয়ার নাম দেওয়া হয় সুজান এবং তার ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৬০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর কিরকুকের নাম। নাদিয়ার পরিচয় হয় ওমরের স্ত্রী। নাদিয়া সারা রাত জেগে তার নতুন নাম, পরিচয়, সাজানো গল্প বারবার মুখস্ত করেন। সামান্য একটু ভুলও হতে পারে তাদের মৃত্যুর কারণ।
নির্দিষ্ট দিনে তারা মসুল ছেড়ে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু প্রথম চেকপয়েন্টেেই তাদের গাড়ি থামানো হয়। আইএস সদস্যরা গাড়ি তল্লাশি করতে শুরু করে। তারা ওমর আর নাদিয়ার কাগজপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে এবং ওমরকে জেরা করতে থাকে- সাথে কে, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কবে ফিরবে ইত্যাদি। গল্প আগে থেকেই সাজানো ছিল। ওমর উত্তর দেন, স্ত্রীকে নিয়ে তার বাবা-মাকে দেখতে কিরকুক যাচ্ছেন। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে অবশেষে আইএসরা তাদেরকে ছেড়ে দেয়।
পুরো সময়টা নাদিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিলেন। কারণ চেক পয়েন্টে যখন গাড়ি থামানো হয়েছিল, তখনই তার চোখে পড়েছিল সাইনবোর্ডের উপর। সেখানে অন্য দুটি মেয়ের সাথে ওয়ান্টেড তালিকায় স্থান পেয়েছিল তার ছবিও। আইএস সদস্যরা যদি তার নিকাব সরাতে বলতো, তাহলেই হয়ত তিনি ধরা পড়ে যেতেন। কিন্তু যে কঠোর ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে আইএস তাদের অন্যায়গুলোকে বৈধতা দেয়, তার কল্যাণেই হয়তো শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সবগুলো চেকপয়েন্টের কোনোটিতেই তাকে নিকাব সরাতে বলেনি কেউ।
আইএসের কাছ থেকে পালিয়ে আসার পর নাদিয়া মুরাদ জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হন। মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী আমাল ক্লুনির সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দী ইয়াজিদি নারী ও যাঁরা পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
নোবেল কমিটি বলেছে, নাদিয়া এত কষ্ট সহ্য করেও অন্যদের পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন।
Rocky Ahmed publisher