দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ভারতীয় সৈন্যরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের সম্পর্কে কিছু বলবেন?

1 Answers   5.5 K

Answered 2 years ago

১৯৪৫ সাল। ২ সেপ্টেম্বর। মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে জাপান। অবসান হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল। ইতিহাসের সবথেকে ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছিল গোটা বিশ্ব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা একনজরে

ভারত তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ। ২৩ লাখেরও বেশি ঔপনিবেশিক ভারতের জওয়ান অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৮৯ হাজার জওয়ান। ভারতীয় জওয়ানরা উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকা অভিযান, পশ্চিমের মরু-অভিযান এবং ইউরোপে অংশ নিয়েছিলেন।

তবে জাপানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতেই বেশিরভাগ ভারতীয় জওয়ানকে ব্যবহার করা হয়েছিল। টব্রুক, মন্টি ক্যাসিনো, কোহিমা এবং ইম্ফলের যুদ্ধে ভারতীয় জওয়ানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটেন, ভারত ও আফ্রিকার সম্মিলিত ফোর্টিন্থ আর্মি মিত্রশক্তির হয়ে বার্মা পুনর্দখল করে। ব্রিটিশদের হয়ে লড়াইয়ে সাহসিকতা দেখানোর জন্য ৩০ জন ভারতীয় ভিক্টোরিয়া ক্রস পান।

কোহিমায় ভারতীয়দের বীরত্বের গাথা

কোহিমা ও ইম্ফলের যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় পর্বে সবচেয়ে বেশি রক্তাক্ত হয়েছিল। বার্মায় জাপানের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ জওয়ানই প্রাণ হারায় এই যুদ্ধে। ২০২১ সালে ব্রিটেনের ন্যাশনাল আর্মি জাদুঘরে সেরা যুদ্ধের প্রতিযোগিতায় এই যুদ্ধের নাম ছিল সবার উপরে। ওয়াটারলু এবং ডি-ডে -কেও পিছনে ফেলে দিয়েছিল এই যুদ্ধ। ১৯৪২ সালে বার্মা থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত করে জাপানের সেনা। এরপরই দু’বছর পরই বার্মা পুনরূদ্ধারের জন্য শুরু হয় যুদ্ধ।

লেফটেন্যান্ট জেনেরাল রেনিয়া মুতাগুচি তাঁর জাপানি ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের রাজি করিয়ে নেন ইম্ফল এবং কোহিমাতে ব্রিটিশ বাহিনী আক্রমণ করার জন্য। লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিরোধ করা। জেনেরাল মুতাগুচি ব্রিটিশ রাজের ভিতকে নড়িয়ে দিতে ভারতে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করেন। অন্যদিকে ব্রিটিশদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনেরাল উইলিয়াম স্লিম।

জাপানের অতর্কিত হানা

জেনেরাল স্লিম পশ্চিম বার্মা থেকে তাঁর বাহিনী সরিয়ে নিয়েছিলেন। ইম্পাল উপত্যকার আশপাশের পাহাড়ে সুরক্ষিত জায়গাগুলিতে সরিয়ে আনেন সেনাকে। জাপানিদের সাপ্লাই লাইন থেকে অনেকটা দূরে যুদ্ধে নামানোর কৌশল করেছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও ব্রিটিশ কমান্ডারই বিশ্বাস করতে পারেননি, কোহিমার দুর্ভেদ্য জঙ্গল পার করে যাবে জাপানের সেনা। ৪ এপ্রিল যখন প্রায় ১৫ হাজার জাপানি সেনা জওয়ান জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন মাত্র ১৫০০ ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনা ছিলেন অন্য প্রান্তে। চারিদিক থেকে ঘিরে নিয়েছিল জাপানি সেনা। ফলে নতুন করে শক্তি বাড়ানো বা সাপ্লাই পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছিল ব্রিটিশ ও ভারতীয় জওয়ানদের জন্য। ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সেনা।

এরপর জাপানি সেনার আকাশপথে সাহায্য ও সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পরে মিত্র শক্তি খুব কম সময়েই কোহিমা ও ইম্ফলের আশপাশের পাহাড়ি এলাকা থেকে জাপানি সেনাকে হটাতে সক্ষম হয়। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন, ১৯৪৪ ব্রিটিশ এবং ভারতীয় বাহিনী জাপানিদের শেষ ঘাঁটিটিকেও ইম্ফল এবং কোহিমা সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। ভারতে আগ্রাসনের জন্য ৮৫ হাজার জওয়ানের শক্তিসমৃদ্ধ জাপানের ১৫তম সেনাবাহিনী মূলত ধ্বংস হয়ে যায়। ৫৩ হাজার জন জাপানি জওয়ান মারা যায়। নিখোঁজও হয়েছিল অনেকে। অন্যদিকে ১৬,৫০০ জন ব্রিটিশ মারা গেছিল।

ভারতীয়দের কাছে ঋণী ব্রিটিশ রাজ

ভারতও ত্রাণ সরবরাহ করেছিল। ভারত মহাসাগরের উপরে ভারতের কৌশলগত অবস্থান এবং এর ক্রমাগত অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের ফলে জাপানকে সহজেই প্রতিহত করেছিল ব্রিটিশরা। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় কারখানা ও ফার্মগুলি সচল রাখার জন্য ১৪ মিলিয়ন ভারতীয় শ্রমিক দিনরাত কাজ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, ব্রিটেন যুদ্ধের জন্য অন্য দেশগুলি থেকে ৩ বিলিয়ন ইউরো ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে ১.২৫ বিলিয়ন ইউরো শুধুমাত্র ভারত থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এই ঋণ কোনওদিনই মেটানো হয়নি।

ইতালিতে যুদ্ধে ভারতীয় সেনার অবদান

প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয় সেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লড়েছিলেন ইতালিতে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ১৯ বছর থেকে ২২ বছর বয়সের মধ্যে। ১৯৪৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম ভারতীয় সেনা জওয়ানরা নেপলসের দক্ষিণে তারাটোতে অবতরণ করে। ততদিনে ১৯৪৪ সালের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত তারা ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ইট্যালির হয়ে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিলেন। ৫৭৮২ জন ভারতীয় জওয়ান মারা গেছিলেন।

এই সময়ে ২০ জন ভিক্টোরিয়া ক্রস পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে ছয়জন ভারতীয় ছিলেন। সিপাহি কমল রাম (৩/৪ পঞ্জাব), এন কে যশবন্ত ঘাড়গে – মরণোত্তর (৩/৫ মারাঠা লাইট ইনফ্যানন্ট্রি), সিপাহি নামদেব যাদব (১/৫ মারাঠা লাইট ইনফ্যানন্ট্রি), রাইফেলম্যান শের বাহাদুর থাপা (১/৯ গোর্খা রাইফেলস), রাইফেলম্যান থামান গুরুং – মরণোত্তর (৫ গোর্খা রাইফেলস) এবং সিপাহি হায়দার আলি (৬/১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলস)।

ভারতের প্রশংসায় ব্রিটেন

১৯৪২ সাল থেকে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ বলেছিলেন, “ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী না থাকলে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পার করা যেত না।” ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল একসময় ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্যের জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনিও ভারতীয় সেনা ও আধিকারিকদের সাহসিকতাকে শ্রদ্ধা জানান।

Suriya Sultana
suriyasultana
519 Points

Popular Questions