রিটায়ারমেন্ট ইন থাইল্যান্ডঃ সিন সিটি বা পাপের শহর পাতায়াতে সর্বদা যে কেবলমাত্র পাপ উৎপন্ন হয়ে চলেছে তা নয়। এখানে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য অনেক প্রাকৃতিক দৃশ্যমণ্ডিত চমৎকার সব স্থান আছে। আছে অসংখ্য বুদ্ধ টেম্পল, অত্যন্ত সুচারু ভাবে সাজানো বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফুলের বাগান, সাদা বালির অনেকগুলো সমুদ্র সৈকত, স্যাংচুয়ারী, মিউজিয়াম, কার্টুন থিম পার্ক, সার্কাস আর নানা ধরনের শো। এগুলোর কয়েকটা দেখার জন্য ডে লং প্যাকেজ কিনলাম হোটেলের কাছের টুরিস্ট শপ থেকে। প্যাকেজ কিনে পিকাপের জন্য হোটেলের নাম ঠিকানা দিয়ে বের হয়ে আসছিলাম। এসময় ভেতরের দিক থেকে আমাকে এক থাই ভদ্রলোক ডাকলেন। কাছে যেতেই বললেন, সাদি কাপ (হ্যালো), আমি চন বুই। তা পাতায়া আপনার কেমন লাগছে? আমি বললাম, বেশ ভালো লাগছে। চন বুই বললেন, তাহলে এখানে রিটায়ার করে যান। আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই তিনি বললেন, আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন? আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। চন বললেন, কেন আপনি লক্ষ্য করেননি এখানে অনেক ইউরোপীয় আর আমেরিকান বৃদ্ধ রয়েছেন। আমি বললাম, হ্যাঁ সর্বত্রই এখানে সাদা চামড়ার বৃদ্ধ মানুষদের আনাগোনা দেখছি বটে। চন বললেন, এরা সবাই রিটায়ার করা ফারাং। এরা ইউরোপ বা আমেরিকাতে নিজ দেশে চাকুরী শেষ করে রিটায়ারে গেছে তবে ওদেরকে সান্নিধ্য দেয়ার মত কেউ নেই। ওদের দেশের প্রথা মত ছেলে মেয়েরা আঠার বছর হওয়ার পর ভার্সিটির হোস্টেলে চলে যায়, নানা কাজ করে বা সরকার থেকে লোন নিয়ে পড়ার খরচ চালায়। ক্রমে বাবা মার সাথে যোগাযোগ কমে যায়। ছেলেমেয়েরা আর্থিক ভাবে স্বাধীন আর বাবা মাও তাই- লেনদেন নাই, নির্ভরশীলতাও নাই, ফলে সম্পর্ক হয়ে যায় ফিকে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সম্পর্ক লোপ পেয়ে যায়। রিটায়ারে যাবার সময় তাঁদের পাশে ছেলে মেয়ে বা নাতি নাত্নীরা কেউ থাকে না। তাই ওরা বুড়ো বয়সে নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচতে, শীতের হাত থেকে বাঁচতে, ওদের দেশের তুলনায় অনেক কম খরচে স্বচ্ছল আনন্দময় সময় কাটাতে থাইল্যান্ডে রিটায়ারমেন্ট ভিসা নিয়ে বাস করে। আমি রিটায়ারমেন্ট ভিসা প্রসেসিং এর এডভোকেট। তুমি চাইলে ফী এর বিনিময়ে থাইল্যান্ডে অবসর জীবন কাটানর ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
বিষয়টা শুনে অবাক হলাম। আমি বললাম, আমাদের দেশে এখনও অবসরের পরে বয়স্করা ছেলেমেয়ে বা পরিবারের সাথেই থাকে। চুই বললেন, তোমাদের পার কেপিটা আয় কত? আমি বললাম, এক হাজার পাঁচ শত ডলারের মত তবে ভীসণ ২০৪১ বাস্তবায়িত হবার পর আমরাও ধনী দেশের কাতারে দাঁড়াব। চুই বললেন, তোমরা এখনও দরিদ্র সমাজ ভুক্ত। তোমাদের মত আর্থিক অবস্থা ইউরোপ আমেরিকায় ৬০/৭০ বছর আগে ছিল। তখন তারা তোমাদের মতই অবসর জীবন কাটাত পরিবার পরিজনের সাথে। কিন্তু এখন তাঁদের আয় অনেক বেড়ে গেছে, সবাই স্বনির্ভর হয়ে যাওয়াতে, ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়াতে কেউ কাউকে সময় দিতে পারে না। তাই তারা তুলনামূলক ভাবে কম খরচের এ দেশে এসে চমৎকার অবসর জীবন কাটায়। আমি বললাম, কিন্তু এখানে রিটায়ার করে কি লাভ? চুই বললেন, থাইলান্ড তোমার বেশ ভালো লাগছে বলছিলে? কিন্তু কেন? আমি বললাম, থাইল্যান্ড এক কথায় অসাধারণ। রাস্তা ঘাট হোটেল ভবনাদি সব পরিষ্কার পরিছন্ন, চমৎকার সব খাবার, জ্যাম বিহীন রাস্তা ঘাট, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, মিশুক ভদ্র থাই মানুষদের সান্নিধ্য আকর্ষণীয়। চুই আমাকে থামালেন। বললেন, এর বাইরে থাই সুন্দরী বিয়ে করার সুযোগও আছে। ঐ বিষয়টাও আমি দেখভাল করি। এই নাও বিদেশী বিবাহে ইচ্ছুক থাই মেয়েদের ছবির এ্যালবাম। দেখ। চিন্তা কর। কার্ড রাখ। প্রয়োজনে যোগাযোগ করিও। এ্যালবামটা কিছুক্ষন উল্টেপাল্টে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এখানে কি কোন বাংলাদেশী অবসর ভোগী আছে? চুই হা হা করে হেসে বললেন, ২০৪১ সালের দিকে তোমাদের দেশ উন্নত হয়ে উঠলে বাংলাদেশী রিটায়ারিদেরও এখানে দেখতে পাব আশা করি।
আমি টুরিস্ট শপ থেকে বের হয়ে এলাম। পরবর্তীতে ব্যাংকক আর পাতায়াতে দেখেছি অনেক বয়স্ক মানুষ এখানে বাস করে। ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার অবসর ভোগীরা মাসে ৩/৪ হাজার ডলার ভাতা পায়।এই অর্থ দিয়ে থাইল্যান্ডের যে কোন শহরে ফ্ল্যাট বা কন্ডো লংটার্মে ভাড়া নিয়ে বসবাস করা যায়। অনেকে দরিদ্র থাই তরুণীদের বিয়ে করে নেয়। তবে কেউ কেউ বিয়ে করে না কারন থাই কালচারে মেয়েদের পিতার পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। তাই দরিদ্র থাই তরুনী বিয়ে করলে সেই বউ এর পিতার পরিবারের ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হয়। এটা থেকে বাঁচতে অনেক অবসরভোগী ফারাং বিয়ে না করে এস্ক্ট সার্ভিস থেকে তরুনীদের শর্ট বা লং টার্মে হায়ার করে। এসব সুবিধার জন্য থাইল্যান্ড পাশ্চাত্যের বৃদ্ধদের রিটায়ারমেন্টের এক চমৎকার স্থান বটে। তবে পাশ্চাত্যের বৃদ্ধদের জীবন বোধের সাথে আমাদের দেশের বুড়োদের জীবন বোধের আকাশ পাতাল তফাৎ আছে। আমার এক কলিগ বলছিলেন, তার সদ্য স্কুলে যাওয়া শুরু করা ভাগ্নীর ধারণা- তার বাবা অফিসে চাকুরী করে আর নানা মসজিদে চাকুরী করে। পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের অবসর ভোগীদের জীবনবোধের এই ভিন্ন ধাঁচের ধারনার কোনটি ভাল তা কে জানে?
munnisha05 publisher