Answered 2 years ago
হাহাহা, একটা মজার গল্প বলে এর উত্তর শুরু করা যাক ।
গল্পের নাম "নারীর মূল্য", রচয়িতা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় । গল্পের কথক একজন মাসিক পত্রিকার সম্পাদক, যার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে যে বৈরাগ্য সাধনের শ্রেষ্ট উপায় হল পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান । একদিন সকালে অফিসে বসে খবরের কাগজ খুলে কথক দেখলেন জনৈক বৈরাগী বৈজ্ঞানিক হিসেব করে বের করেছেন যে মানুষের শরীরে যে পরিমাণ লোহা আছে তা দিয়ে একটি মাত্র পেরেক আর যে পরিমাণ গন্ধক আর ফসফরাস আছে তা দিয়ে পাঁচটি মাত্র দেশলাই কাঠি নির্মাণ করা সম্ভব ! এর ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে যে বাজারদর অনুযায়ী মানুষের মূল্য হল গিয়ে মোটে আঠারো টাকা !
কথক সবেমাত্র এইটুকু পড়েছেন এমন সময় অফিসে সাক্ষাৎ বিপদস্বরূপ আবির্ভাব একজন ঘোর সুন্দরী তরুণীর । কিন্তু কথক তখন অকুতোভয় । মেয়েটি কিছু বলবার আগেই তিনি কঠিন স্বরে তাকে জানালেন যে তাঁর মূল্য মোটে আঠারো টাকা । কিন্তু এই কথায় অপ্রস্তুত হওয়া দূরে থাক, মেয়েটি হেসে উঠে এমন রসিকতা শুরু করলো যে কথকের বৈরাগ্য আরোই বিপন্ন হয়ে পড়লো । বেগতিক দেখে মেয়েটির রসিকতার সমুচিত জবাব দিতে তিনি এবার তাকে বললেন যে তাঁর শরীরের সমস্ত লোহা মাত্র একটি পেরেকের ও সমস্ত গন্ধক কেবল পাঁচটি দেশলাই কাঠির সমতুল্য ।
কিন্তু মেয়েটি দমবার পাত্রী নয় । উল্টে তাঁর হাসির মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো । এইবারে কথক বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন যে তাঁর কথায় মেয়েটি কেন রাগ করছে না । তখন মেয়েটি তাকে জানালো যে সে আসলে কথককে তাঁর দাদার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে এসেছে (কারণ তাঁরা পূর্বপরিচিত) আর সে জানে যে কথকের মাথায় একটু ছিট আছে ।
কথকও এবার মেয়েটিকে চিনতে পারলেন কিন্তু তাঁর মাথায় ছিট আছে বলায় সেইসাথে তাঁর ভারী রাগও হল । তিনি ভ্রূকুটি করে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন এবং মেয়েটিকে আরো একবার মনে করিয়ে দিলেন যে তাঁর মূল্য মোটে আঠারো টাকা । যুবতীটি হাসিমুখে সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিল ।
এর মাসকয়েক পরের কথা—কথকের বিয়ে-পরবর্তী ফুলশয্যার রাত । কথকের পাশে বিছানায় বসে সেদিনের সেই হাস্যরসিকা তরুণী ! নিজের স্বভাবসিদ্ধ রসিকতাপূর্ণ ভঙ্গিতে নবোঢ়া তরুণী কথককে মাত্র ক'টা টাকার জন্য নিজের বৈরাগ্য বিসর্জন দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে কথকমশাই মাথা চুলকে জানালেন, "আমার হিসেবে একটা ভুল ছিল; একটা জিনিস বাদ পড়ে গিয়েছিলো ।"
"কী?"
"তুমি ।"
উপরের গল্পটা মজার কেন? কারণ মানুষকে কতকগুলো অজৈব পদার্থের সমষ্টিতে হ্রাসযোগ্য (reducible) করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বৈরাগ্যসাধনের উপায় হিসেবে । প্রেম আর জ্ঞানের দ্বন্দ্বটাও একইরকম । প্রেমকে মানুষ যতই শুধু ডোপামিন, অক্সিটোসিনের খেলা হিসেবে বোঝার চেষ্টা করুক, মানুষের মস্তিষ্ককে পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষণ করুক, অনুভূতিটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় । প্রেম নিয়ে তাই যত জ্ঞান আর পরোক্ষ অভিজ্ঞতাই থাক, নিজের মধ্যে এই অনুভূতির সঞ্চার হলে সেগুলো কাজে দেবে, এমন কোনো নিশ্চয়তাই নেই ।
তবে আমি এতে আশংকিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না । বরং তার চেয়ে অনেক শ্রেয় হল এটাকে এমন একটা উপলব্ধি হিসেবে দেখা যা মানুষের জ্ঞানের দম্ভকে প্রশমিত করতে পারে । তাকে এটা বোঝাতে পারে যে যুক্তির চেয়েও শক্তিশালী জিনিস এই দুনিয়ায় আছে, যাকে অস্বীকার করে নয় বরং মেনে নিয়েই আমাদের সত্যের অন্বেষণে অগ্রসর হওয়া উচিত ।
deb05485 publisher