কন্যা কি সম্পদ নাকি সম্পত্তি?

1 Answers   8.6 K

Answered 2 years ago

বৃদ্ধনিবাস কক্ষ নম্বর ৭০১: বৃদ্ধ অচল ব্যারিস্টার রশিদ সাহেব তাঁর জীবনের শেষ চার বছর কাটিয়েছেন ওই ৭০১ নম্বর কক্ষে। গত শতকের সত্তরের দশকে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে থিতু হন। একসময় দেশে এসে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে চলে যান। ইংল্যান্ডে তাঁর একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হয়। ৯০ এর দশকে বাংলাদেশের একটি বড় এনজিওর পরিচালকের সঙ্গে ইংল্যান্ডে তার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নতুন দশকের শুরুতে বহুমুখী কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত এনজিওটির মালিক রশিদ সাহেবকে বাংলাদেশে এসে তাঁর এনজিও তে যোগদান করে আইনগত বিষয়গুলো দেখার জন্য অনুরোধ করলে তিনি দেশে চলে আসেন। ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবের স্ত্রী ইতিমধ্যেই গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন আর ছেলেমেয়েরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্তে ছিল তাই ইংল্যান্ডে তাঁর স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা রয়ে গেলেন।

এনজিওটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিত হয়ে উঠলো এবং বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সাথে অনেক শাখা খুলে পরিচালিত হতে লাগলো। রশিদ সাহেব এরই মাঝে কর্মসূত্রে এক মহিলার সঙ্গে পরিচিত হলেন। দুটি মেয়ে রেখে ভদ্রমহিলার স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশে ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবের একাকিত্বের জীবন থাকায় একপর্যায়ে তিনি সেই মহিলার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন এবং অবশেষে বিয়ে করলেন।

গুলশানের একটি ভবনে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। তার একটিতে থাকতেন অপরটি ভাড়া দিয়েছিলেন। বিয়ের পর স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে দুটোকে নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন এবং পিতৃস্নেহে বড় করে তুললেন। তার বর্তমান স্ত্রী খুবই ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। আগের পক্ষের ছেলেমেয়েরা লন্ডন থেকে বাংলাদেশে পিতাকে দেখতে এলে বাসায় উঠতে দিতেন না। তাই তারা তাদের মায়ের দিকের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে উঠতেন এবং পিতার সঙ্গে কয়েক দিন সময় কাটিয়ে আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যেতেন। তার বর্তমান স্ত্রী আগের পক্ষের ছেলে মেয়েদের বাংলাদেশে পিতার সাথে দেখা করতে আসার বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি। তিনি গুলশানের বাড়ি দুটো তার নামে লিখে দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন। রশিদ সাহেবের বয়স প্রায় ৬৭ হয়েছিল। তিনি উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। স্ত্রী এবং স্ত্রীর আগের পক্ষের দুটো মেয়ে আর তাদের আত্মীয়-স্বজনের বহুমুখী চাপের ফলে এক পর্যায়ে তিনি ফ্ল্যাট দুটো স্ত্রীর নামে লিখে দিতে বাধ্য হলেন। তাছাড়া স্ত্রী ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবের সকল একাউন্ট যৌথনামে করে নিলেন।

ব্যারিস্টার সাহেব চেয়েছিলেন বহুমূল্য ফ্ল্যাট দুটির একটি বাংলাদেশের স্ত্রীর নামে দেবেন অপরটি তার আগের পক্ষের ছেলে-মেয়ে দুটো নামে দেবেন কিন্তু সেটা না করতে পারার ফলে তিনি গভীর মনোকষ্টে ভুগতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। তার শরীরের অর্ধাংশ প্যারালাইসড হয়ে গেল। স্ত্রী প্যারালাইসিসে আক্রান্ত setting sun ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবকে দেখাশোনা করতে রাজি হলেন না। তিনি তাকে ঢাকার একটি বৃদ্ধনিবাসে পাঠিয়ে দিলেন। ব্যারিস্টার রফিক সাহেবের ঠাঁই হলো বৃদ্ধনিবাস এর কক্ষ নম্বর ৭০১ এ।

বৃদ্ধনিবাসে ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবের কেয়ার গিভিংয়ের খরচ হিসাবে মাসে পয়তাল্লিশ হাজার টাকা দিতে হতো। চার মাস পর রশিদ সাহেবের শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হলে ডাক্তাররা বললেন ইলেক্ট্রোলাইট ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন অন্তত দুটো করে ডাব খাওয়াতে হবে, তাছাড়া একদিন অন্তর অন্তর ফিজিওথেরাপি দিতে হবে। এতে আরও অতিরিক্ত দশ হাজার টাকা প্রয়োজন। ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবের ফ্ল্যাটের দখলদার স্ত্রী setting sun এর জন্য আরও অতিরিক্ত টাকা দিতে রাজি হলেন না। তিনি বৃদ্ধ নিবাসের সম্পাদিকাকে লন্ডনে থাকা ব্যারিস্টার রশিদ সাহেবের ছেলে মেয়ের ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন, ওদের কাছ থেকে টাকা নেবেন আমি আর এনার জন্য টাকা দেব না।

সিনিয়র সিটিজেন হোমের সম্পাদিকা উপায় না দেখে লন্ডনে থাকা মেয়ের কাছে ফোন করলেন। মেয়েটি জানাল, দিন দশেকের মধ্যে সে বাংলাদেশে আসবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ততদিন তারা যেন কেয়ার গিভিং এ কোনো কার্পণ্য না করেন।

১১ দিনের মাথায় ব্যারিস্টার রাশিদ সাহেবের মেয়ে রেবেকা দেশ এলো। তার বিমাতা গুলশানের দুটো ফ্ল্যাট বাবার কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়েছে এমনকি জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে থাকা যাবতীয় অর্থ উঠিয়ে নিয়েছেন আর এখন বাবার জন্য মাসে সামান্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চান না জেনে মর্মাহত হলেন। যাক নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধ নিবাসের যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করলেন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা নিয়ে গেলেন যেন তিনি আর ভাই মিলে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারে।

রেবেকা সপ্তাহ খানেক বাংলাদেশে ছিল সেই দিনগুলোতে বাবার পাশে বসে থাকতো, বাবার কেয়ার গিভিং এর জন্য যে ছেলেটি নিযুক্ত ছিল তার সাথে তিনি ছোট ভাইয়ের মতো ব্যবহার করতেন এবং যাবার আগে তাকে বিশ হাজার টাকা এবং বেশ কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে গেলেন। রশিদ সাহেব প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও ডিমনেশিয়ায় ভুগছিলেন। তিনি জড়িয়ে জড়িয়ে কোনরকমে কথা বলতেন। চার পাঁচ মাস পরপর মেয়ে রেবেকা পিতাকে দেখার জন্য বাংলাদেশে আসতেন এবং সপ্তাহ খানেক থেকে আবার লন্ডনে ফিরে যেতেন। রেবেকা ছিলেন খুবই হাসিখুশি মিশুক এবং দানশীল। কেয়ার গিভার ছেলেটিও তার পিতা ব্যারিস্টার রশিদকে প্রাণ দিয়ে যত্ন করতো। কখনো-কখনো রশিদ সাহেব রাত এগারোটায় এমনকি রাত চারটার সময়ও চা খেতে চাইতেন আর কেয়ারগিভার ছেলেটির বিরক্ত না হয়েও চা বানিয়ে দিত।

২০২০ সালের মার্চ মাসে ব্যারিস্টার রশিদ ভোরের দিকে ম্যাসিব হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন এবং ৭০১ নম্বর কক্ষে প্রাণ ত্যাগ করলেন। লন্ডনে মেয়ে রেবেকাকে খবর দিতেই ভাই এবং বোন জানালেন মরদেহ হিমাগারে সংরক্ষন করতে যেন তারা ঢাকায় এসে শেষ বারের মত বাবাকে দেখতে পারেন।

পিতাকে কবরস্থ করে ভাইবোন লন্ডনে ফিরে গেল তবে প্রতিবছর মার্চ মাসে রেবেকা বাংলাদেশে আসেন। আর আসার পরেই সিনিয়ার সিটিজেন হোমে এসে প্রতি রুমে রুমে গিয়ে সকলের সাথে সাক্ষাৎ করেন আর প্রত্যেকের হাতে চকলেট তুলে দেন। যে কেয়ার গিভার শেষ দিনগুলোতে তার বাবাকে দেখাশোনা করেছিল তাঁকে ডেকে বেশ কিছু টাকা দেন আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনুমতি নিয়ে তার বাবা ৭০১ নং কক্ষের যে খাটটিতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন সেটা স্পর্শ করে কিছুক্ষণ বসে থাকেন তারপর অশ্রু বিসর্জন করতে করতে চলে যান।

কন্যা সম্পত্তি নয় কন্যা হলো সম্পদ।

Fiya
fiya
241 Points

Popular Questions