ইকমিক কুকার সম্বন্ধে জানাবেন কি?

1 Answers   9.6 K

Answered 3 years ago

তখনও মাইক্রোওভেন আসেনি , এমনকি আসেনি গ্যাস ওভেনও | প্রেসার কুকারও ঢোকেনি বাঙালীর রান্নাঘরে |

কথা হচ্ছে উনবিংশ শতকের | অত্যন্ত আনুষঙ্গিক হিসেবে তখন রান্নাঘরের সাথে থাকত একটি জরুরী বিভাগ—জ্বলানী কাঠ , কয়লা , গুল , ঘুঁটের ভাঁড়ার হিসেবে |

হুগলীর গুপ্তিপাড়ার মল্লিকবাড়ীতেও ওভাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে রান্না হত | পরিবর্তন একটা এল এরপর ওবাড়ীর রাধাগোবিন্দ মল্লিকের পুত্র ইন্দুমাধব মল্লিকের হাত ধরে | হঠাৎ রান্নার কথা বলতে বলতে মল্লিকবাড়ীর হেঁসেল হয়ে এই যে মল্লিক বাড়ীর ব্যক্তিগত কথায় ঢুকে পড়লাম তার নিশ্চিত কারন আছে বৈকি |

প্রথমত বাঙালী হিসেবে একজন বিস্মৃতপ্রায় বাঙালীকে জনসমক্ষে তুলে ধরার দায় তো রয়েইছে | তার ওপর যদি সে বাঙালী হন অতীব মেধাবী ও কৃতী কেউ |

৪ ঠা ডিসেম্বর ,১৮৬৯ ইন্দুমাধব মল্লিকের জন্ম | ১৮৯১ সালে দর্শনে মাস্টার ডিগ্রী দিয়ে শুরু হয় তার স্নাতকোত্তর সিরিজের সূচনা | দর্শন ছাড়াও পরপর পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে পদার্থবিদ্যা , আইন , উদ্ভিদবিদ্যা , প্রানীবিদ্যা ও শারীরবিদ্যাতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন | পড়াশোনার মাঝখানেই ১৮৯৭ সালে বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন | আবার ১৯০০ সালে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন ওকালতি | ১৯০৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন এম. ডি |

একাধারে তিনি ছিলেন সুলেখক , ভ্রমণপিপাসুও | তাঁর বিদেশভ্রম্ণ ও চীন ভ্রমণের ওপর লেখা বইও রয়েছে | মনোভাবে ছিলেন জাতীয়তাবাদী | তাই হয়ত দেওঘরে আলিপুর বোমা পরীক্ষাকালে গুরুতর আহত বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের চিকিৎসা তিনি নিজের হাতে করেছিলেন | ৮ই মে , ১৯১৭ মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন |

যাবার আগে পদচিন্হ স্বরূপ রেখে যান ১৯১০ সালে তার আবিস্কৃত ইকমিক কুকার , যার দ্বারা খুব সহজে ও তাড়াতাড়ি জ্বালানী সাশ্রয়ের মাধ্যমে সুস্বাদু রান্না করা হত |

তিনি সচেতন ছিলেন খাদ্য, পুষ্টি ও খাদ্যবিধি ( hygiene) সম্পর্কে , তাই এব্যপারে সচেতনতা প্রসারেও তিনি ব্রতী হন | ইকমিক কুকার আবিস্কার কিন্তু তার এই মনোভাবকেই প্রকাশ করেছে | কারন এই পদ্ধতিতে রান্নায় , খাদ্যের খাদ্যগুণ সবচেয়ে বেশী বজায় থাকে |

যদিও আজকের প্রজন্মের কাছে অদেখা ইকমিক কুকার , আর অজানা তার আবিস্কারক , তবুও এই আবিস্কারের দ্বারা সেযুগের রান্নাঘরে এসেছিল আধুনিকতার চমক | শোনা যায় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ভোগ রান্নার পদ্ধতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই আবিস্কার করেন |

ইকমিক কুকার , নামটি কিভাবে এল জানা নেই | আন্দাজ করা হয় ….ইকনমিক কুকারের অপভ্রংশ হয়ত | জানা যায় আবিস্কর্তার নামে কেউ কেউ একে মল্লিক কুকারও বলতেন | ভ্রমণপিপাসু খাদ্যরসিক বাঙালিরা নাকি সেযুগে ট্রেনে করে ভ্রমণের সময়েও এটি সঙ্গে নিয়ে যেতেন | আজও নাকি কলকাতার বউবাজারে দেখা মেলে ইকমিক কুকারের |

যাইহোক , প্রথম দিকে এটি পেতল নির্মিত ছিল | কাঠকয়লার আঁচে বা স্টীমে রান্না হত | ভেতরে মুলতঃ তিনটি বা চারটি পাত্র বা প্রকোষ্ঠ ছিল , ফলে একসাথে ভাত , ডাল , সব্জী রান্না হত সহজেই | কুকার বলেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এতে ভাজা বা সেঁকা খাবার করা যেত না | আমাদের আজকের অধুনা কুকার এসেছে এর অনেক পরে | আজও অনেকের কাছে সংরক্ষিত রয়ে গেছে সেদিনের ইকমিক কুকার |

কিন্তু কথা হল , সত্যিই কি হারিয়ে গেছে ইকমিক কুকার ?

উত্তরটা একাধারে হ্যাঁ, আবার না ও | ” হ্যাঁ ” এজন্য যে আর হয়ত পেতলের বৃহদাকার মল্লিক কুকার আপনি কিনতে পাবেন না , কারন তার প্রোডাকশন নেই | আর ” না ” এজন্য যে , যুগের সাথে সাথে সব কিছুরই তো পরিবর্তন হয় , উন্নয়ন হয় | ধরে নেওয়া যেতেই পারে আজকেও ইকমিক কুকার জেগে রয়েছে দক্ষিণীদের ইডলী প্রস্তুতের তৈজস হিসেবে , পাহাড়ের মানুষদের মোমো প্রস্তুতের তৈজস হিসেবে | হোক না সেগুলো আ্যলুমিনিয়াম নির্মিত |

পরিশেষে বলি সমস্ত ছবিগুলি সংগৃহিত | ছবিগুলি হাতে পেয়ে দুকলম লেখার ইচ্ছে হয়েছিল মাত্র | এসব তথ্য অজানা কিছুই নয় , শুধুই পুরনো দিনকে ঘুরে দেখার অভিপ্রায় | আর একটা ছোট্ট কথা না বললে খামতি থাকবে | সেদিনের গুপ্তিপাড়ার মল্লিকেরা এখন ভবানীপুরে থাকেন |

ভাবছেন , তাতে কি হল ?

তাতে হল অনেক কিছুই |

ইন্দুমাধব মল্লিকের নাতি এখনও আছেন সেই ভবানীপুরের বাড়ীতে , যে কোনও সময় আপনি তাঁর সাথে দেখা করতে পারেন | কীভাবে ? ৭০, ৮০ , ৯০ এর দশকের অধিকাংশ বাংলা সিনেমায় পেয়ে যাবেন রঞ্জিত মল্লিককে |


Popy Khatun
popykhatun
473 Points

Popular Questions