Answered 2 years ago
চন্দ্রদ্বীপ- বাংলার এক বিস্মৃত জনপদঃ-
--------------------------------------------------------------------------
চন্দ্রদ্বীপ মুগল-পূর্ব যুগের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য এবং মুগল যুগের একটি বড় জমিদারি। মধ্যযুগের শেষ দিকে বাখরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ব্যাপী চন্দ্রদ্বীপ জমিদারি বিস্তৃত ছিল। সরকার বাকলার নামানুসারে অনেক সময় একে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বলা হতো। কচুয়া ছিল এ জমিদারির প্রধান কেন্দ্র। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরপরই নিয়মিত রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থতার কারণে চন্দ্রদ্বীপ জমিদারি নিলামে বিক্রয় হয়ে যায়। ক্রেতাদের মধ্যে ছিলেন মাধবপাশার জনৈক মুদী দোকানী। ঊনিশ শতকের প্রথম থেকে মাধবপাশা চন্দ্রদ্বীপের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
চন্দ্রদ্বীপের বৌদ্ধ দেবী ‘তারা’ গুপ্ত যুগেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। খ্রিস্টীয় পাঁচ বা ছয় শতকে বৈয়াকরণিক চন্দ্রগোমিন চন্দ্রদ্বীপে বাস করার সময় তাঁর প্রসিদ্ধ তারাস্তোত্র রচনা করেন বলে অনুমিত হয়। চৈনিক লেখকদের মতে, তারা দেবীর মন্দির দক্ষিণ সাগর অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ছিল। ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের একটি পান্ডুলিপিতেও চন্দ্রদ্বীপের তারা মূর্তি ও মন্দিরের ইঙ্গিত রয়েছে।
শ্রেষ্ঠ চন্দ্র নৃপতি শ্রীচন্দ্রের রামপাল তাম্রশাসনএ চন্দ্রদ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ তাম্রশাসনে দেখা যায়, দশ শতকের সূচনায় ওই বংশের ত্রৈলোক্যচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের রাজা হন। দক্ষিণ ভারতীয় লেখনী এবং আইন-ই-আকবরীর সাক্ষ্য হতে মনে হয়, চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের অন্য নাম ছিল ‘বঙ্গালদেশ’। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের বাকলা সরকার (বর্তমান বরিশাল, পূর্বের বাখরগঞ্জ জেলা) এবং চন্দ্রদ্বীপ একই স্থান বলে স্বীকৃত। চন্দ্রদ্বীপ বা বাখরগঞ্জ অঞ্চল তেরো শতকে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেও জানা যায়। তেরো শতকের বিশ্বরূপ সেনের মধ্যপাড়া বা সাহিত্য পরিষদ লিপিতে ‘বাঙ্গালবড়া’ এবং ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামের দুটি স্থানের নাম রয়েছে। শেষোক্তটিকে অনেকেই চন্দ্রদ্বীপ হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। আইন-ই-আকবরী-তে বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপের রাজা পরমানন্দ রায়ের উল্লেখ আছে।
স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে চন্দ্রদ্বীপের কায়স্থ বসুবংশীয় জমিদারগণের আদিপুরুষ দনুজমর্দনদেব এর অধিকার প্রায় সমগ্র বাখরগঞ্জ জেলায় স্বীকৃত ছিল। কথিত আছে যে, তিনি চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী নামীয় একজন ব্রাহ্মণের কৃপায় রাজ্য লাভ করেন এবং উক্ত ব্রাহ্মণের নামেই রাজ্যের নামকরণ করেন ‘চন্দ্রদ্বীপ’। এ কাহিনীর ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে মনে হয় না। তবে রাজা দনুজমর্দনদেব নামাঙ্কিত একটি রৌপ্যমুদ্রা খুলনা জেলার বাসুদেবপাড়া নামক গ্রামে পাওয়া গেছে। মুদ্রাটির একদিকে ‘শ্রী শ্রী দনুজমর্দনদেব’, অপরদিকে ‘শ্রী শ্রী চন্ডীচরণ পরায়ণ সম্বৎ ১৩৩৯’ এবং চারদিকে ‘চন্ডদ্বীপ’ কথাগুলি লেখা রয়েছে।
পূর্ব বাংলার যে সকল জমিদার কিছু কালের জন্য মুগল প্রভুত্ব স্থাপনে প্রতিরোধ রচনা করেন, সে বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে পরমানন্দের পৌত্র কন্দর্পনারায়ণ রায় সবিশেষ প্রসিদ্ধ। কন্দর্পনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের সীমানা সম্ভবত পশ্চিমে যশোহর এবং উত্তরে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। বহিরাক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার জন্য তিনি রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে সমুদ্রোপকূলে এক সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেন। কন্দর্পনারায়ণ রায় বরিশালের পশ্চিম-উত্তর কোণে ক্ষুদ্রকাঠিতে একটি দিঘি খনন করেন।
১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে রালফ ফিচ চন্দ্রদ্বীপ পরিদর্শন করে একটি মনোজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। শ্রীপুরের রূপিয়া খাঁ কর্তৃক নির্মিত এবং কন্দর্পনারায়ণের নামাঙ্কিত কিঞ্চিদধিক পাঁচ হাত দীর্ঘ একটি পিতলের কামান দীর্ঘকাল পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপের রাজধানীতে রক্ষিত ছিল।
কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র যশোহরের প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিন্দুমতীকে বিবাহ করেন। অবশ্য এ ঘটনার মাধ্যমে যশোহর ও চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল বলে মনে হয়। রামচন্দ্র ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে হোসেনপুরে তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেন।
রামচন্দ্র রায়ের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কীর্তিনারায়ণ রায়ও পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন এবং সাফল্য লাভ করেন। তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই প্রতাপনারায়ণ রায় চন্দ্রদ্বীপের পরবর্তী নৃপতি হন। প্রতাপনারায়ণ রায়ের সময়ই সম্ভবত মুসলমানগণ বাকলা চন্দ্রদ্বীপ দখল করেন।
কালক্রমে চন্দ্রদ্বীপের বসু বংশের বিলোপ ঘটলে ঢাকার নিকটবর্তী উলাইলের মিত্র মজুমদার বংশ চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি লাভ করেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পরপরই চন্দ্রদ্বীপ জমিদারির অধিকাংশ ক্রমে নিলামে বিক্রি হয়।
তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড, শুভদীপ সিনহা মহাশয়ের লেখা পোস্ট
fiazfuad publisher