Answered 2 years ago
আমি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমি বর্তমানে Technical University of Munich এ পিএইচডি করছি। তার আগে University of Bonn থেকে মাস্টার্স এবং বাংলাদেশে Dhaka University থেকে ব্যাচেলর কমপ্লিট করেছি।
ঢাবিতে আমার ছাত্রজীবন ছিলো আমার জীবনের একটি কালো অধ্যায়। অনিয়মিত ক্লাস, সীমিত গবেষণার সুযোগ, আর মান্ধাতা আমলের ল্যাব ফেসিলিটির কারণে ব্যাচেলরে এ অনেক কিছুই শেখা হয় নি। কিছু শিক্ষকের ব্যাপারে কি আর বলবো। এদের কথা বার্তা শুনলেই বুঝা যায় এরা শিক্ষক কিভাবে হয়েছে। এদের মধ্যে দুই-একজন ভালো শিক্ষকও পেয়েছি কিন্তু তারা ছিলেন ফ্যাকাল্টিতে চরমভাবে অবহেলিত শিক্ষক। যাইহোক, ওই দুই একজন শিক্ষকের জন্যই আমি ঢাবিকে এখনো স্মরণ করি। পড়াশুনা, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এ ক্লাস নেওয়া, GRE, IELTS, এবং German Language নিয়ে ব্যাস্ত থাকার কারণে আমি আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে মেশার সময় খুব একটা পাই নি। সেজন্যে যখনই ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি নিজেকে অনেকটা আউটসাইডার মনে হয়েছে। অবশ্য আমি হলে থাকি নি। হলে থাকলে হয়তোবা ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। তবে হলের পরিবেশ দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো। এর চেয়ে ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের কেম্পেও ভালো ফেসিলিটি আছে।
ছবি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ)
ব্যাচেলর শেষ করে চলে এলাম জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ বন এ এস্ট্রোফিজিক্স এ মাষ্টার্স করার জন্য। এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিলো। এখানে এসে প্রথমবারের ওয়ার্ল্ড ক্লাস ফিজিক্স ল্যাব এর সাথে পরিচিত হলাম। ঢাবিতে সবচেয়ে বড় যে প্রবলেমটি ছিলো সেটি হচ্ছে এস্ট্রোফিজিক্স বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য যে বিশাল পরিমাণ ডেটা হ্যান্ডেল করা দরকার সেটার জন্য কোনো তেমন শক্তিশালী কমপিউটার ছিল না। পার্সনাল কমপিউটার এসব এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য যথেষ্ঠ নয়। যাইহোক, মাষ্টার্স এ ভর্তি হয়ে প্রথম সেমিস্টারে বুঝতে পারলাম আমি কতটা পিছিয়ে আছি। আমার ক্লাসমেটদের সবার সি++, পাইথন, ফোরত্রান, ইত্যাদি ল্যাঙ্গুয়েজ এ সলিড কোডিং স্কিল ছিলো অন্যদিকে আমার প্রোগ্রামিং স্কিল ছিল একেবারেই বেসিক লেভেলে। আমি নিজেকে গণিতের পোকা হিসেবেই জানতাম কিন্তু ইউনিভারসিটি অফ বন এখানেও আমাকে ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। যাইহোক, অনেক কিছুতে পিছিয়ে থাকার কারণে চার সেমিস্টারের মাষ্টার্স প্রোগ্রাম (ছয় মাসের সেমিস্টার) শেষ করতে আমার লেগেছে সাত সেমিস্টার। ইউনিভার্সিটি অফ বন এর সবকিছুই পজিটিভ শুধু একটা বিষয় ছাড়া। সেটা হচ্ছে ড্রপ আউট রেইট। এখানে ড্রপ আউট রেইট অনেক বেশি (৬০% এর আশেপাশে)। অনেক ছেলেমেয়েকে দেখেছি সব কোর্স শেষ করে লাস্ট এ এসে কোনো একটা কোর্সে তিনবার ফেইল করে ড্রপ আউট হয়ে যেতে। যাইহোক, আমি মাস্টার্স শেষ করতে সময় একটু বেশি নিলেও আমার সিজিপিএ খুবই ভালো ছিলো।
ছবি: ইউনিভার্সিটি অফ বন
বন এ এসে জীবনে প্রথম ডরমিটরি তে থাকলাম। জাতী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে ডরমিটরিতে থাকার আলাদা একটা মজা আছে। তখনই জীবনে প্রথম ইউনিভার্সিটি লাইফটাকে উপভোগ করা শুরু করলাম। অবশ্য প্রথম সেমিস্টারের পর পড়াশুনার চাপে সেটার অনেকটাই উধাও হয়ে গিয়েছিলো। তারপরও সপ্তাহে একদিন বিকেলের সময়টা রাখতাম বন্ধুদের সাথে পার্টি করার জন্য (শনিবার সন্ধ্যা)। ইউনিভার্সিটি অফ বনেই প্রথমবার বিভিন্ন দেশের কিছু ছেলেমেয়ের সাথে লাইফ লং ফ্রেন্ডশিপ গড়ে উঠে যাদের সাথে এখনো আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়।
মাস্টার্স শেষ করার পর কয়েকবছর একটা মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জব করেছি। কিন্তু চাকুরীরত অবস্থায় আমার বারবারই মনে হয়েছে কর্পোরেট লাইফ আমার জন্য না। তাছাড়া আমি যেই জব করতাম সেটার সাথে এস্ট্রোফিজিক্স এর তেমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না বললেই চলে। তাই যেই কয় বছর চাকুরী করেছি সেটা ছিল অর্থের প্রয়োজনে অনেকটা নিজের সাথে যুদ্ধ করেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের প্যাশন এর কাছে প্রয়োজনকে হার মানতে বাধ্য করলাম এবং পিএইচডির জন্য চেষ্ঠা করতে থাকলাম। ইচ্ছে ছিলো ক্যামব্রিজ কিংবা ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি করবো কিন্তু দুটোর কোনটা থেকেই কোনো সুপারভাইজারকে পিএইচডি প্রজেক্টের জন্য কনভিন্স করতে পারলাম না। দুই জায়গা থেকে রিজেকশন খেলেও তাদের ফিডব্যাকগুলো কাজে লেগেছে। আর সেকারণেই হয়তোবা পরবর্তীতে Technical University Munich এর এক প্রফেসরের আমার রিসার্স প্রপোজাল পছন্দ হয়েছিলো। ২০২১ সালে TU Munich এ আমার পিএইচডির যাত্রা শুরু হয়। কবে শেষ হবে জানি না। তবে TUM নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেইন নেই। এটা জার্মানির সবচেয়ে বড় বাজেটের ফ্ল্যাগশীপ ইউনিভার্সিটি। এখানে রিসার্স ফেসিলিটি আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। শুধু একটাই সমস্যা, আর সেটা হচ্ছে আমার নিজের ধৈর্য্য এবং সামর্থ্য নিয়ে। অনেক সময় প্রেসারের কারণে বার্নট আউট হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। তখন মনে হয় এত কষ্ট না করে, সব ছেড়ে দেশে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরাম আয়েশে জীবন পার করে দিলেই বোধয় ভালো হতো। আর এজন্য মাঝে মাঝে এসব আজে বাজে চিন্তা থেকে মস্তিষ্ককে অন্যদিকে ডাইভার্ট করার জন্য কোরায় এসে বকবক করি!
Rumi publisher