আদিম সমাজের মানুষেরা কোথায় বসবাস করত?

1 Answers   12.3 K

Answered 2 years ago

মোটাভাবে কয়েকটা কথা।

১। আদিম বলতে আমি বুঝেছি ২০,০০০ বছর আগের মানুষদেরকে। তাঁরা বনে থাকতো আর তাদের কোনো বাড়িঘর কিছু ছিলোনা। তাঁরা উলংগ থাকতেন, কেননা কাপড় আবিষ্কার হয়েছে মাত্র ৬ হাজার বছর আগে, আর শুরুতে রাজাবাদশা ছাড়া লেংটি পরার ক্ষমতাও লোকের ছিলোনা। আপনি যদি বনের গরিলা, শিম্পাঞ্জি, আর ওরাংউটাং দেখেন, তাহলে কিছুটা মিল পেয়ে যাবেন আদিম মানুষের জীবন যাপনের সাথে।

২। বনে থাকার মূল কারণ ছিলো বনে ঘাস হয়না (গাছের ছায়ার কারণে) তাই সেখানে ঘাসখেকো গরু-ছাগল-হরিণ থাকে না বলে বাঘ-সিংহ-হায়েনা থাকে না। আর মানুষ ঘাসের প্রান্তরে গেলে কোন খাবার পাবে না, কেননা মানুষ ঘাস খায় না। আপনি পাকা ধানের খেতে গরিলা-শিম্পাঞ্জি ছেড়ে দিয়ে দেখেনঃ ওরা ধান খাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করছে না। মানুষ মেরে খাবার মত শক্তিমান বাঘ-সিংহ সেখানে থাকে। বনে মানুষ গাছের ফল কূড়িয়ে খেতো, কিছু ছাল-বাকল লতাপাতা খেতো। তারা ছোটখাটো কিছু বনবাসী প্রাণী মেরে খেতো। তাদের দাঁত দেখে বুঝা যায় তারা তেমন কোন মাংস খেতো না।

৩। বনের মানুষের গড় আয়ু ২৫ বছরের কম ছিলো। খাবারের অভাবে নয়, বরং ঔষধ ও চিকিৎসার অভাবে শিশু বয়সে মরে যেত বেশির ভাগ মানুষ। অবাক হবার কিছু নেই। হাজার হাজার বছরের উন্নতির পরেও ১৯০০ সালের দিকে আমাদের দেশের লোকের গড় আয়ু ছিল ২৫-২৬ বছর। ১৯৬০ সালেও সেটা ৪৪ বছর ছাড়ায়নি। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, পেটের ক্রিমি, হাম ছিলো আতঙ্কজনকঃ গ্রামের পর গ্রাম উজার করে মানুষ মেরে যেত এইসব রোগ। মনে রাখবেন যেকালে কবিরাজগণ চিকিতসা করতেন, সেকালে মানুষ বাঁচতো খুব কম। আয়ূর্বেদ মানে আয়ু কম। একদল মিথ্যাবাদী বলে যে আগে মানুষের আয়ু বেশি ছিলো_একদম ডাহা মিথ্যা।

৪। বনে ঘর বানাবার সুযোগ ছিলো না কারণ খাবারের সন্ধানে তারা ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হতো। মানুষ প্রতিরক্ষার স্বার্থে এক সাথে চলাফেরা করত। দলবদ্ধ একটি দলে নারী-পুরুষ শিশুবুড়ো মিলে ২৫ জনের মত লোক ছিলো। এদের জন্য কমপক্ষে ৪০০ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল দরকার ছিলো যাতে সারা বছর যথেষ্ট খাবার মিলার আশা ছিলো। নানা রকম ফল বছরের নানা সময়ে ফলতোঃ একই জায়গায় সারা বছর থাকার উপায় ছিলো না। যদি পরিবারের লোক সংখ্যা বেড়ে যেত তাহলে এক বনে আর জায়গা হতোনাঃ দলটি ভেঙ্গে দুই টুকরা হয়ে যেতো। আর যদি দলের লোকের সংখ্যা যদি অর্ধেক বা কম হয়ে যেতো, সেটা মারা পড়তো। একটা ছোট দল আত্মরক্ষা করতে পারতো না, বিশেষ করে বাঘ-সিংহ হানা দিলে।

৫। আনুমানিক ২০,০০০ বছর আগে কিছু মানুষ প্রকৃতির নিয়মের উলটা কাজ শুরু করে। নিয়ম হল শিকারি প্রাণী শিকার ধরে সাথে সাথেই মেরে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। কিন্তু কিছু মানুষ শিকার ধরে সেটাকে না মেরে বরং সেটাকে পালন করা শুরু করলোঃ সেটাকে তারা অন্যদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখে আর নিজে ওদের খাবার যোগার করে দিতে শুরু করলো। যে মুরগিটাকে জবাই করে খেয়ে ফেলার কথা, সেটা বেঁচে রইলো আর ডিম পাড়ল আর সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটালো। ডিমটা না খেয়ে সেটা থেকে বাচ্চা হবার সুযোগ দিলো, আর বাচ্চা না খেয়ে সেটাকে বড় হতে দিলো, যাতে বড় হয়ে এরাও ডিম দিতে পারে। মুরগির আর মুরগির ডিমের পরিমাণ গেলো বেড়ে। ক্রমে মানুষ না্না জাতের পশু আর পাখি পালন করতে শুরু করলো।

৬। পশুপালন আবিষ্কারের ফল মানুষ বন ছেড়ে চলে গেলো ঘাসের ময়দানে, আর যাযাবর জীবনের বাইরে শুরু করলো আধা-যাযাবর জীবন। নারী ও শিশুদেরকে প্রান্তরের একটা জলাশয়ের পাড়ে রেখে পুরুষরা চলে গেল মাঠে গরু-ভেড়া-ছাগল-শুকর চরাতে। মেয়েরা সাময়িক ক্যাম্পে থাকতে শুরু করল। প্রায় দশ হাজার বছর পরে মানুষ কৃষি আবিষ্কার করল, আর তার সাথে এলো স্থায়ী ঘর ও ফসলের গোলাঘর বানানো। গ্রাম বানানো হল ফসলের মাঠে আর শুরু হল সভ্যতার বিকাশ।

৭। আদিম মানুষের সংখ্যা মাত্র ২৫০০০ বা অনুরূপ ছিলো। এর আগে ২ লাখ বছর ধরে জনসংখ্যা বাড়েনি, কারণ মৃত্যুহার এতো বেশি ছিল যে জনসংখ্যা বাড়ার উপায় ছিলো না। আসলে বর্তমান প্রজাতির মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স) ছাড়া বাকি সকল প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মূল কারণ অষুধের অভাব।

৮। পশুপালন আবিষ্কারের একটা ফল হলো প্রোটিন-ভরা দুধ, ডিম, আর মাংস আগের চেয়ে অনেক বেশি খেতে পাওয়ার ফলে মানুষের আয়ু কিছুটা বেড়ে গেল। ধারণা করা যায় যে গড় আয়ূ ২৫ বছর থেকে বেড়ে ২৮-৩০ বছর হয়ে যায়। এতে লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রায় ১০ হাজার বছর ধরে লোকের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এসে দাঁড়ায় আনুমানিক ৫০ লাখেঃ আগের চেয়ে ২০০ গূন বেশি। এর পরে কৃষি আবিষ্কারের ফলে মানুষ মরতে ভুলে যেতে থাকেঃ তাদের আয়ু বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ বছরে আর মানুষের সংখ্যা আধা কোটি থেকে বেড়ে ৭৫ কোটি হয়ে যায় ১০ হাজার বছরে। আগে মানুষ ঘাস খায়নি, ঘাসের দানা তার খাবার ছিলো না। কিন্তু কৃষি নিয়ে এলো ঘাসের দানা, আর এতো বিশাল পরিমাণে যে ১০ হাজার বছরে লোকের সংখ্যা ১৫০ গূন বেড়ে গেলো।

৯। মাত্র ২৫০ বছর আগে শুরু হয় শিল্পবিপ্লব। এর মূল কথা হলো প্রকৃতির শক্তিকে দিয়ে কাজ করানো। হাঁটার জন্য আর পা লাগেনা, মানুষ গাড়ি বা বিমান চড়ে আরামে যায় দূরে-দূরান্তে। ফসলের মাঠে কাজ করে দানবীয় মেশিন, আর ফসল এতো বেশি যে ২০২০ সালে ১৩৬০ কোটি লোকের জন্য যথেষ্ট খাবার উৎপাদন করা হয়, যদিও আসলে মাত্র ৭৮০ কোটি লোক ছিলো। শহর বলে আগে কিছু ছিলো নাঃ রাজা বাদশারা সেনাদলে ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে বাস করতেন, আর সেখানে রাজাগজাদের নানা কাজের চাকর-বাকর কারিগর থাকতো। অই রকম শহর খুব অল্প ছিলো। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর সাধারণ মানুষ হাল চাষ ফেলে চলে এলো শহরে, শিল্প-কারখানায় কাজ করতে। উন্নত দেশুগুলিতে ৯০% এরো বেশি লোক শহরে থাকে। এখন শিল্পের চেয়েও বেশি বেড়ে গেছে নানা রকম সেবা ও ব্যবসা। চিকিৎসা এত উন্নত হয়েছে যে মানুষ মরতে ভুলে গিয়ে গড়ে৭৫ বছরের বেশি বাঁচে। মৃত্যুহার প্রচন্ড কমে যাওয়ায় আগে দশ হাজার বছরে যত লোক বাড়তো, এখন এক বছরেই তার চেয়ে বেশি বাড়ে। ২০২২ সালে দুনিয়াতে ৮০০ কোটি লোক আছে। কিন্তু খাবার আছে ১৪০০ কোটি লোকের। ২০,০০০ বছর আগে ১৬ বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ১ জনের খাবার হতোঃ এখন সেখানে ৮০,০০০ লোকের খাবার হয়।

১০। এই হলো কিসসাঃ বনের যাযাবর উলংগ প্রাণী একদিন চলে গেল ঘাসের মাঠে, তারপর গেলো বন্যা-প্লাবিত সমতলে চাষের জমিতে গ্রাম বানিয়ে। তারপর তারা শহর বানিয়ে পাড়ি দিল শহরে।

Anitk Mahmud
antik
284 Points

Popular Questions